শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ২৫ শতাংশের বেশি। আর ওই মাসের হিসাবে ঢাকায় চারজনের একটি পরিবারের সাধারণ খাবার খরচ দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার টাকার বেশি। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারকে এখন তাদের মোট আয়ের ৬০ শতাংশ খরচ করতে হয় সাধারণ খাদ্যের পেছনে।
সিপিডি বলছে, ফেব্রুয়ারি মাসে খাদ্যপণ্যের দাম বা মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২৫.১১ শতাংশ। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে ফেব্রয়ারিতে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ৮.১৩ শতাংশ।
যেভাবে খাদ্যের খরচ বাড়ছে
গত পাঁচ বছরে চার সদস্যের একটি পরিবারে খাবারের পেছনে প্রতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে কত টাকা খরচ করতে হতো তারও হিসাব দিয়েছে সিপিডি। তাতে দেখা যায়, ২০১৯ সালে একটি পরিবারের নিয়মিত খাবারের পেছনে মাসে খরচ হতো ১৫ হাজার ৭০৫ টাকা। খাদ্য তালিকা থেকে মাছ-মাংস বাদ দিলে খরচ হতো চার হাজার ৭১২ টাকা। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিয়মিত খাবারের পেছনে খরচ হতো ১৬ হাজার ৮১৩ টাকা। মাছ-মাংস ছাড়া খরচ হতো পাঁচ হাজার ২৬৫ টাকা। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিয়মিত খাবারের পেছনে খরচ হতো ১৭ হাজার ৫২ টাকা। মাছ মাংস ছাড়া খরচ হতো পাঁচ হাজার ৩২৩ টাকা। ২০২২ সালে খাবারের পেছনে মাসে খরচ ছিল ১৮ হাজার ১১৫ টাকা। খাদ্যতালিকা থেকে মাছ-মাংস বাদ দিয়ে ব্যয় দাঁড়িয়েছিল পাঁচ হাজার ৬৮৮ টাকা। আর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নিয়মিত খাবারের খরচ দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৬৬৪ টাকা। এবং মাছ-মাংস ছাড়া খরচ পড়ছে সাত হাজার ১৩১ টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে একটি পরিবারের নিয়মিত খাবারের পেছনে ব্যয় বেড়েছে ছয় হাজার ৯৬৯ টাকা। মাছ মাংস ছাড়া খাবারের পেছনে ব্যয় বেড়েছে ২ হাজার ৪১৯ টাকা।
সিপিডি যা বলছে
সোমবার এই গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। সিপিডির মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে পণ্যের দাম বেড়েছ, তার চেয়েও বেশি হারে বাড়ছে দেশের স্থানীয় বাজারে। বিশেষ করে চাল, আটা, চিনি, ভোজ্য তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমলেও স্থানীয় বাজারে সেই প্রভাব নেই। অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত পণ্যের দামও কারণ ছাড়া ঊর্ধ্বমুখী। বাজার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটির কারণে এমন হচ্ছে।
সিপিডি মনে করে, অর্থনৈতিক দুঃসময়ের কারণ হিসেবে ইউক্রেন যুদ্ধকে আর অজুহাত করার সুযোগ নেই। অর্থনীতির ভেতরে থাকা দুর্বলতা এখন মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধের প্রভাব কিছুটা থাকলেও বাকিটা দেশের অর্থনীতির শক্তিমত্তার বিষয়।
সিপিডি বলছে, লাগামহীন মূল্যস্ফীতির কারণে অনেকেই খাদ্য ব্যয় কমিয়ে আনতে খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছেন মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন আমিষ। তাই পরিস্থিতি সামলাতে বেবসরকারি খাতে পাঁচ শতাংশ বেতন বাড়ানোর সুপারিশ করেছে তারা।
তাহলে সংকট কোথায়? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধকে সরকার যে দায়ী করবে এখন সেই সুযোগ নাই। এখন আমাদের অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ সংকট এর জন্য দায়ী। আগে অনেক ছোট ছোট ব্যবসায়ী আমদানি করতে পারতেন, তারা এখন আমদানি করতে পারছেন না। আমদানি চলে গেছে কিছু বড় বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। ফলে বাজারে প্রতিযোগিতা নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক ব্যবসায়ী এখন চাইলেও আমদানি করতে পারছেন না। কারণ ছোট বলে তারা ডলার পাচ্ছেন না। আর গুজব, ভুল তথ্য দিয়ে দাম বাড়ানোর একটি পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। ফলে দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও বাড়ছে। আবার নিষেধাজ্ঞার কথা বলেও ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিচ্ছে। এই বিষয়গুলো না দেখলে তো পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।’
মুরগির দাম কেজিতে ১০০ টাকা কমল কীভাবে?
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের(ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘আমরা আগেই বলেছি দ্রব্যমূল্যের চাপে মানুষ কম খাচ্ছে। খাবারের তালিকা থেকে কাটছাট করছে। এর প্রভাব পড়ছে মানুষের স্বাস্থ্য ও পুষ্টিতে। কিন্তু দ্রব্যমূলের এই যে ঊর্ধ্বগতি সেটা যুক্তি ছাড়া। কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই ব্রয়লার মুরগির দাম কেজি ১৬০ টাকা থেকে ২৯০ টাকা হয়ে গেল এক মাসের মধ্যে। কিন্তু বাজারে মনিটরিং বাড়িয়ে ব্যবসায়ীদের চাপ দেওয়ায় এখন তিন-চার দিনের মধ্যে কেজি ১৮০ টাকায় নেমে এসেছে। এতে এটাই প্রমাণিত হয় বাজারে খাদ্যপণ্যের কোনো সরবরাহ সংকট নাই। ব্যবসায়ীরা মুনাফা লুটতে সংকট তৈরি করছে। খেজুর ৮০-৯০ টাকা কেজি আমদানি করে ৬০০-১৮০০ টাকা কেজি বিক্রি করা হয়। ব্যবসায়ীদের এই লোভ কে দমন করবে? দেশটা যেন ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।’ বলেন নাজের হোসেন।
তার কথা, ‘ব্যবসায়ীদের কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন ইউক্রেন যুদ্ধ শুধু বাংলাদেশেই হচ্ছে। সারা দুনিয়ায় এখন দাম কমছে। আমাদের এখানে বাড়ছে। ভারতে তো তেমন বাড়ে নাই। আমাদের এখানে কেন বাড়ছে?’
খাদ্য ছাড়া আর তো কাটছাঁটের জায়গা নেই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন বলেন, ‘সাধারণ মানুষ খাদ্য তালিকা কাটছাঁট করছে। কারণ আর কোনো খাতে সে খরচ কমাতে পারছে না। যেমন চাইলেই যে বাসা ভাড়া কমাতে পারছে না, বাচ্চার স্কুলের খরচ কমাতে পারছে না। কিন্তু বাচ্চার দুধের খরচ কম কিনে কমিয়ে ফেলতে পারছে। মাছ-মাংস না খেয়ে খরচ কমাতে পারছে।’
এই শিক্ষক বলেন, ‘খাদ্য তালিকায় কাটছাট করায় শিশুরা অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। তাদের বৃদ্ধি ঠিকমত হচ্ছে না। তাদের মেধা ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রন্ত হচ্ছে। আবার যারা বয়স্ক তাদের শরীরের ক্ষয়রোধ ঠিক মতো হচ্ছে না। দীর্ঘ মেয়াদে এর লক্ষণগুলোও স্পষ্ট হবে।’ সূত্র: ডয়চে ভেলে