কারাগার শাস্তির জায়গা নয়, কারাগার হলো সংশোধনাগার। নতুন জীবন গঠনে কারাগারে বন্দিদের বিভিন্ন ধরনের কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরে কারামুক্ত হয়ে প্রশিক্ষণ অনুযায়ী কাজ করে নতুন জীবনের সূচনা করেছেন অনেকেই। আবার কারাগারে প্রশিক্ষণকালীন কাজের দক্ষতা, আচার-আচরণে মুগ্ধতা ছড়াতে পারলে মিলছে সরকারি সহায়তা। এভাবে সরকারি সহায়তা দিয়ে ২৪ বছর আড়াই মাস কারাভোগের পর নতুন জীবনের সূচনা করেছেন লক্ষ্মীপুরের জাহাঙ্গীর আলম।
তিনি সদর উপজেলার উত্তর মহাদেবপুর গ্রামের মো. মজিবুল হকের ছেলে। স্ত্রীকে হত্যার দায়ে তিনি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২৪ বছর আড়াই মাস কারাবন্দি ছিলেন। কারাগারে থেকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে সংশোধনের প্রমাণ দিয়েছেন। তাই সরকারি সহায়তায় তাকে একটি কম্পিউটার দোকান উপহার দেওয়া হয়েছে।
জেলা কারাগার সূত্র জানায়, স্ত্রী ফাতেমা বেগমকে হত্যার দায়ে ১৯৯৮ সালের ১৬ অক্টোবর কারাবন্দি হন জাহাঙ্গীর। ২০০১ সালে লক্ষ্মীপুর জজ আদালত স্ত্রী হত্যার দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। পরে উচ্চ আদালতে আপিল করলে রায় সংশোধন করে বিচারক তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। ২৪ বছর আড়াই মাস কারাভোগ শেষে তিনি গেল জানুয়ারি মাসে মুক্ত হন। তবে কারাবন্দি থাকাকালীন কম্পিউটার প্রশিক্ষণে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন জাহাঙ্গীর। প্রায় ৭-৮ মাস আগে জেলা প্রশাসক (ডিসি) আনোয়ার হোসেন কারাগার পরিদর্শনে যান। তখন গ্রাফিক্সে জাহাঙ্গীরের আঁকা পদ্মাসেতুর ডিজাইন ডিসির নজরে আসে।
ডিসির ভাষ্যমতে, ‘পদ্মাসেতুর গ্রাফিক্সটি অসাধারণ হয়েছে। এটি নতুন জীবন গঠনে জাহাঙ্গীরের জন্য এটি নবসূচনা হতে পারে’। এ সময় সঙ্গে থাকা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক নুরুল ইসলাম পাটওয়ারীকে বিষয়টি নিয়ে বিবেচনার জন্য বলেন ডিসি। সে লক্ষ্যেই জাহাঙ্গীর কারামুক্ত হওয়ার পর সমাজসেবা অধিদপ্তরের অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসন সমিতির আওতায় কম্পিউটারের দোকানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।
জেলা সমাজসেবা কার্যালয় সূত্র জানা যায়, অপরাধীদের সংশোধনের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় সমাজসেবা অধিদপ্তর বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসন সমিতির আওতায় জাহাঙ্গীরকে কম্পিউটার দোকানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। বুধবার (২২ মার্চ) রায়পুর উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের রাখালিয়া বাজারে জাহাঙ্গীরের ‘বিছমিল্লাহ টেলিকম অ্যান্ড ফটোশপ’ দোকানের উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক আনোয়ার হোছাইন আকন্দ। এর আগে ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর যাবজ্জীবন সাজা শেষে মিলন কামাল নামে একজনকে সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের আবদুল্লাহপুর গ্রামে সেলুন দোকান উপহার দেওয়া হয়।
জাহাঙ্গীরের দোকান উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক নুরুল ইসলাম পাটওয়ারী, রায়পুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অনজন দাশ, জেলা কারাগারের জেল সুপার নজরুল ইসলাম, রায়পুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাসেল ইকবাল, সোনাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইউসুফ জালাল কিসমত প্রমুখ।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, যেদিন বিচারক আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন, সেদিনই আমি মরে গেছি। আল্লাহর রহমতে আমি বেঁচে আছি। পরে জেল আপিল করলে উচ্চ আদালত আমাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। আমি আমার অপরাধের সাজা পেয়েছি। কারাগারে থাকাকালীন আমি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েছি। সরকার আমাকে একটি কম্পিউটার দোকান উপহার দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। বাকি জীবন ভালোভাবে অতিবাহিত করতে সবার দোয়া ও সহযোগিতা চাই।
জেলা কারাগারের জেল সুপার নজরুল ইসলাম বলেন, কারাগার শাস্তির স্থান নয়। কারাগার হলো সংশোধনাগার। কারাগারে এখন বন্দিরা নিজেদেরকে সংশোধন করতে কাজ করছেন। লক্ষ্মীপুরে এ নিয়ে কারামুক্ত দুই ব্যক্তিকে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে জীবনকে নতুন করে সাজানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। আশা করছি জাহাঙ্গীরের ভবিষ্যৎ জীবন উজ্জ্বল হবে। তবে চারপাশের মানুষের তাকে সহযোগিতা করতে হবে। অপরাধীকে নয়, অপরাধকে ঘৃণা করতে হবে। জাহাঙ্গীরের প্রতি কেউ বৈরী আচরণ যেন না করে।
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) আনোয়ার হোছাইন আকন্দ বলেন, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের কারাগারে বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ ও জীবিকা নির্বাহের জন্য সরঞ্জমাদি দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে। সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সরকার সমাজসেবা বিভাগের মাধ্যমে অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসন সমতির মাধ্যমে বন্দিদের এ সেবা দিয়ে আসছে। বাড়ি ফিরে কাজ করে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকতে একজন কয়েদির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে এটি অনেক বড় উপহার। জাহাঙ্গীরকেও সরকারের পক্ষ থেকে উপহার দেওয়া হয়েছে। তিনি জীবনের ২৪টি বছর কারাবন্দি থেকে নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা করেছেন। ভবিষ্যৎ সুন্দর করে সাজাতে তাকে সহযোগিতা করার জন্য সকলকে আহ্বান জানাচ্ছি।