চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি), যা দেশটির অন্যতম শীর্ষ বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃত। বর্তমান মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতে দেশটির অন্যান্য ব্যাংকের মতো এসভিপিও খানিকটা তারল্য সংকটে ভুগছিল, তবে তা একেবারেই নগন্য।
কিন্তু তারপর, মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে একদম দেউলিয়া হয়ে পড়েছে এসভিপি। শুক্রবার ব্যাংকের পরিচালনা কমিটির সদস্যরা দেশজুড়ে এসভিপির সমস্ত শাখা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি।
ব্যাংকটির এই অবস্থার মূল কারণ গুজব। বুধবার হঠাৎ চাউর হয়ে যায়, গুরুতর আর্থিক ঘাটতিতে ভুগছে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক। ঘাটতির পরিমাণ এতটাই যে, ব্যাংকের ব্যালান্স শিটের কিনারা করতেই প্রয়োজন অন্তত ২২৫ কোটি ডলার।
এই গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর এসভিপি থেকে গ্রাহকদের টাকা তোলার হিড়িক পড়ে যায়। বুধবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার ভোররাত পর্যন্ত হাজার হাজার গ্রাহক নিজেদের ব্যাংক হিসাব খালি করে টাকা তুলে নেন এসভিপি থেকে।
ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বুধবার এসভিপির সবগুলো শাখায় মোট ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারেরও বেশি পরিমাণ অর্থ ছিল। কিন্তু গ্রাহকদের প্রায় সবাই টাকা তুলে নেওয়ার পর এখন অবশিষ্ট আছে মাত্র ৯৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার।
শুক্রবার কর্তৃপক্ষ ব্যাংকটি বন্ধ ঘোষণার পর অবশ্য গ্রাহকদের অনেকেই আফসোস করছেন। ডিজিটাল ব্যাংকিং ও আর্থিক পরিষেবাখাতের বিনিয়োগকারী রায়ান ফ্ল্যাভেই সিএনবিসিকে বলেন, ইউনিয়ন স্কয়্যার ভেঞ্চার্স এবং কোচুয়ে ম্যানেজমেন্টসহ কিছু মার্কিন আর্থিক ও ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান এই গুজব ছড়ানোর সঙ্গে যুক্ত। বুধবার তারা এসভিবির বেশ কয়েকজন গ্রাহকের কাছে ইমেইল পাঠিয়ে বলেন, ‘এসভিপি গুরুতর তারল্য সংকটে ভুগছে। যদি ব্যাংকটিতে আপনার টাকা থেকে থাকে— দ্রুত তুলে নিন।’
বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব ইমেইলের স্ক্রিনশট খুব অল্প সময়ের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়, এবং গ্রাহকরাও কোনো প্রকার আগু-পিছু চিন্তা না করে ব্যাংক কার্যালয় কিংবা এটিম বুথ থেকে সমানে নিজেদের আমানতের টাকা তুলে নেওয়া শুরু করেন।
রায়ান ফ্ল্যাভেই বলেন, ‘কেউ যদি আপনাকে বলে— ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে, দ্রুত অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে নিন, দেরি করলে সেই টাকার কোনো হিসাব আর পাবেন না—আপনি কী করবেন?’
‘মানুষজন হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের মতো টাকা তুলেছে। কোনো জনসমাগম পূর্ণ থিয়েটার রুমে হঠাৎ খানিকটা ধোঁয়া দেখা গেলে কেউ যদি আগুন বলে চিৎকার করেন— সেক্ষেত্রে ওই থিয়েটারে যেমন হুটোপুটি শুরু হয়, এখানকার অবস্থাও ছিল অনেকটা তেমনি।’
১৯৮৩ সালে যাত্রা শুরু করে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক, শুরুতে এটির নাম ছিল ক্যালিফোর্নিয়া ব্যাংক। যাত্রা শুরুর পর গত দশকে ব্যাংকটির বিস্তার ঘটে সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও বাইরের বিভিন্ন দেশে ৮ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি কর্মী আছে এসভিবির। এই কর্মীদের অধিকাংশই অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শাখার।
২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক মন্দা শুরু হয়েছিল। সে সময় দেশটির ছোট-বড় অনেক ব্যাংক একের পর এক দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল।
সেই মন্দা পরিস্থিতির ১৫ বছর পর এই প্রথম শীর্ষস্থানীয় কোনো ব্যাংকের এমন আকস্মিক দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটল যুক্তরাষ্ট্রে। একই সঙ্গে এটি দেশটির ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংক ধসের ঘটনা।
বর্তমান পরিস্থিতিতে এসভিবির এভাবে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া অবশ্য মার্কিন অর্থনীতির জন্য অশুভ সংকেত। কারণ গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে দেশটিতে লাগামহীন ভাবে বাড়ছে ডলারের মান। ফলে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ঋণের বিপরীতে সুদের হার বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছিল দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম।
যদি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রে অদূর ভবিষ্যতে রীতিমতো বিশৃঙ্খলা শুরু হওয়ার শঙ্কা আছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে।