শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাজারে এসেছিলেন গার্মেন্টসকর্মী সাজেদুর রহমান। তিনি মিরপুরের একটি গার্মেন্টসে কাজ করেন। ছুটির দিন তাই বাড়িতে একটু ভালো খাওয়ার কথা চিন্তা করে বাজারে আসা। মিরপুর শেওড়াপাড়ার বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম শুনে তিনি তো অবাক! কেজিপ্রতি দাম হাঁকা হচ্ছে ২৪০ টাকা।
সাজেদুর রহমান বলেন, গরু আর খাসির মাংস সামর্থ্যের বাইরে চলে গেছে অনেক আগেই। কখনও মাংস খেতে ইচ্ছা করলে ব্রয়লার মুরগি কিনতাম। কিন্তু সেই মুরগির কেজি আজ ২৪০ টাকা! আমাদের মতো সাধারণ নিম্ন আয়ের ক্রেতারা এখন আর ব্রয়লার মুরগিও খেতে পারবে না। এখন যদি এই অবস্থা হয়, রমজান মাস এলে কী হতে পারে? গরু-খাসির মাংসের মতো আর ব্রয়লার মুরগিও খেতে পারব না!
বাজারে রেকর্ড ছাড়িয়েছে ব্রয়লার মুরগির দাম। কয়েক সপ্তাহ ধরে এই মুরগির দাম দফায় দফায় বেড়ে ২৪০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। কোথাও আবার ২৫০ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হচ্ছে। রমজানের ঠিক আগে যদি এই দাম হয় তাহলে রমজান মাসে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে— তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন সাধারণ ক্রেতারা।
এক মাসের ব্যবধানে বলতে গেলে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ১০০ টাকা। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, এই মুরগির দাম আগে কখনও এতটা বাড়েনি। এবার তা রেকর্ড ছাড়িয়েছে।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) সহকারী পরিচালক নাসির উদ্দিন তালুকদার জানান, গত ৩ মার্চ ব্রয়লার মুরগির বাজার দর ছিল ২৩০/২৪০ টাকা। গত সপ্তাহেও ছিল সর্বোচ্চ ২২০ টাকা। গত বছরের ৩ মার্চ ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছিল ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়। অর্থাৎ এক বছরে প্রায় ১০০ টাকার মতো বেড়েছে এই মুরগির দাম।
টিসিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ব্রয়লার মুরগির কেজি এক সপ্তাহ আগেও ছিল ২০৫ থেকে ২২০ টাকা। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে সপ্তাহের ব্যবধানে ২৪০ গিয়ে ঠেকেছে তা। এক মাসে আগে অর্থাৎ গত ৩ ফেব্রুয়ারি ব্রয়লার মুরগির কেজি ছিল ১৭০ থেকে ১৮৫ টাকা। দাম বেড়েছে ২৩.৯৪ শতাংশ। ঠিক এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের ৩ মার্চ ব্রয়লার মুরগির প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়। ওই হিসাবে এক বছরে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৪১.৯৪ শতাংশ।
হঠাৎ কেন ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়ছে— এমন প্রশ্নের জবাবে কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বাজারে মাল কম। আসলে খামারিরা শীতকালে মাল কম তোলে। কারণ, শীতে মুরগির রোগ-বালাই বেশি হয়, মরে যায়। তাই ওই সময় খামারিরা মুরগির বাচ্চা কিনে না, অনেকে তাদের মুরগির শেড ফাঁকা রাখে। শীতের সময় মুরগির উৎপাদন কম থাকায় বর্তমানে কিছুটা ঘাটতি আছে বাজারে। সেই কারণে দাম বেড়েছে। খামারিরা নতুন মুরগি নেওয়ার পর সেগুলো বড় হয়ে বাজারে আসতে শুরু করলে দাম কমে আসবে। তবে, রমজানের শুরুতে বাড়তি দামেই কেনা লাগতে পারে।
রাজধানীর আজিমপুর কাঁচা বাজারে ব্রয়লার মুরগি কিনতে আসা রিকশাচালক লাল মিয়া বলেন, সামনে রমজান মাস। কিন্তু তার আগেই ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়ে গেছে। রমজান এলে এটার কী অবস্থা হতে পারে? আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষের মাংস খাওয়া ভুলে যেতে হবে। এত দাম দিয়ে মুরগি কিনে খাওয়া আমাদের পক্ষে কি সম্ভব? আজ বাজারে এসেও মুরগি কিনতে পারলাম না। গরুর মাংস যেমন আমরা খেতে পারি না, এখন ব্রয়লার মুরগিও খাওয়া বাদ দিতে হবে।
দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর শান্তিনগরে মুরগি বিক্রি করেন হামিদুর রহমান। তিনি বলেন, এমন দামে ব্রয়লার মুরগি জীবনে কখনও বিক্রি করিনি। এটা বলা যায় ইতিহাসের সর্বোচ্চ দাম। মূলত ফিড ও বাচ্চার দাম এবং পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে। শীতের সময় অনেক খামারি মুরগি তোলেনি। ফলে এই সময় এসে মুরগির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। মূল খামারিদের কাছে এখন বিক্রি করার মতো মুরগি নেই। যে কারণে দাম বেড়েছে। রমজানেও এই বাড়তি দাম থাকতে পারে।
সিরাজগঞ্জের মুরগির খামারি এরশাদ আলী ব্যবসায়িক কাজে কারওয়ান বাজারে এসেছেন। দাম বাড়ার কারণ নিয়ে আলাপকালে তিনি বলেন, শীতের সময় খামারে মুরগি তুলিনি। শেড ফাঁকা ছিল। কারণ, শীতে মুরগির নানা সমস্যা হয়, মরে যায়। ফলে লস হয়। বেশির ভাগ খামারি শীতে মাল তোলেন না। এ কারণে এখন মুরগির সংকট দেখা দিয়েছে। যাদের খামারে মুরগি আছে সেগুলোও প্রায় শেষের দিকে। নতুন করে মুরগি আসলেও বাজার স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা কম।
কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘মুরগির বাচ্চার দাম বেড়েছে অনেক। সেই সঙ্গে মুরগি লালন-পালন, ফিড ও ওষুধের দাম বেড়েছে। বেড়েছে পরিবহন খরচও। সবমিলিয়ে খামারিরা এখন কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেন না। উৎপাদন খরচ অনেক বেশি হওয়ায় আমরাও হিমশিম খাচ্ছি।’
নাগালের বাইরে গরু-খাসির মাংস
নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে গরু ও খাসির মাংস। বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বিভিন্ন সময় ওঠানামা করলেও কখনও কমতে দেখা যায়নি গরুর মাংসের। কয়েক দিন আগেও ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি হতো। এখন তা ৭৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
গেল শুক্রবার (৩ মার্চ) বাজারে গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৭৫০ টাকায়। এর আগের সপ্তাহে তা ৭০০ থেকে ৭২০ টাকার মধ্যে ছিল। এক মাস আগে (৩ ফেব্রুয়ারি) ছিল ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকা। এক বছর আগে অর্থাৎ গত বছরের মার্চ মাসে ৬৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে গরুর মাংস। শবে বরাত ও রমজানে দাম আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।
গরুর মাংসের পাশাপাশি খাসির মাংসের দামও বেড়েছে। আগে ৯০০ থেকে এক হাজার টাকায় খাসির মাংস বিক্রি হলেও বর্তমানে তা ঠেকেছে ১১০০ টাকায়। বিক্রেতাদের মতে, শবে বরাত ও রমজানে খাসির মাংসের দাম আরও বাড়বে।
খাসির মাংস গত ৩ মার্চ বিক্রি হয়েছে ১১০০ টাকায়। এক মাস আগেও তা বিক্রি হয়েছে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকায়। গত বছর মার্চেও ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকায় বিক্রি হতো খাসির মাংস। এক বছরের ব্যবধানে এর দাম বেড়ে বর্তমানে ১১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর বাসাবোর একটি দোকানে গরুর মাংস কিনতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী আহমদ আলী বলেন, উৎসব-আয়োজন অথবা বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন না এলে গরু বা খাসির মাংস কেনা হয় না। এত দাম দিয়ে আমাদের মতো সাধারণ ক্রেতারা কীভাবে মাংস কিনে খাবে? আজ গরুর মাংস কিনতে এসে দেখি আবারও দাম বেড়েছে। ৭৫০ টাকা দিয়ে এক কেজি মাংস কিনে খাওয়া খুবই কঠিন। যেখানে আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলে না সেখানে ৭৫০ টাকায় গরুর মাংস আর ১১০০ টাকায় খাসির মাংস খাওয়া বিলাসিতা ছাড়া কিছুই না। এখনই যদি এই দাম হয় তাহলে রমজান মাসে নিশ্চয়ই আরও বাড়বে। আমরা অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হয়ে আছি।
রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে বিসমিল্লাহ মাংস বিতানের মালিক হুমায়ুন কবির বলেন, বাজারে এমন কিছু নেই যার দাম বাড়েনি। গরুর খাদ্য থেকে শুরু করে পরিবহন খরচ— সবকিছুর দাম আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ফলে গরু বা খাসির মাংসের দামও বেড়েছে। বর্তমান বাজারও চড়া, যে কারণে বাড়তি দামে বিক্রি না করলে ব্যবসা টিকবে না। আগে ৭০০ টাকা বিক্রি করতাম, এখন ৭৩০ থেকে ৭৫০ টাকায় গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে। সামনে শবে বরাত ও রমজান মাস শুরু হবে। তখন দাম আরও বাড়তে পারে। দাম বাড়ার পেছনে আমাদের কোনো হাত থাকে না। যে দামে কিনতে হয়, এর সঙ্গে কিছু লাভ ধরে খুচরা বাজারে বিক্রি করি।
মাংসের দাম বাড়লে আমাদেরই লোকসান— জানিয়ে বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম বলেন, দাম বাড়ায় মানুষ মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। যে দোকানে আগে প্রতিদিন দু-একটি গরু বিক্রি হতো সেই দোকানে এখন একটি গরুর মাংসও বিক্রি হয় না। লোকসানের কারণে অনেকে ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন। অনেক দোকান বন্ধ হয়ে গেছে টিকে থাকতে না পেরে।
‘একজন মাংস ব্যবসায়ীর বাজার থেকে গরু কেনার পর রাস্তার খরচ, বিভিন্ন ধরনের চাঁদাবাজি, পরিবহন ও দোকান খরচ— সবমিলিয়ে দাম নির্ধারণ করতে হয়। এসব খাতে খরচ বেড়ে যাওয়ায় বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। এসব খরচ কমে গেলে কম দামে বিক্রি করা সম্ভব হবে।’
এমনকি ‘গরিবের প্রোটিন’ ডিমের দামও বাড়তি। এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের মার্চ মাসে প্রতি হালি মুরগির ডিমের দাম ছিল ৩৬ থেকে ৪০ টাকা। বর্তমানে তা ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ এক বছরে ডিমের দাম বেড়েছে ১৪.৪৭ শতাংশ। এক মাস আগেও (ফেব্রুয়ারি) প্রতি হালি ডিম বিক্রি হয়েছে ৪৩ থেকে ৪৭ টাকায়।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার ডিম ব্যবসায়ী ফিরোজ আহমেদ বলেন, ডিমের দামের নিয়ন্ত্রণ তো আমাদের হাতে নেই। যখন যে দামে কিনতে পারি তখন সেই দামেই বিক্রি করি। ডিমের দাম গত সপ্তাহে বেড়ে ৫০ টাকা হালি হয়েছিল, পরে তা কমে ৪০/৪৫ টাকা হয়েছে। সামনে রমজান, দাম আরও বাড়তে পারে।
‘বাজার বাড়তি থাকলে বেশি দামেই কিনতে হবে। দাম কমলে ক্রেতারা কম দামেই কিনতে পারবেন’— বলেন এই ব্যবসায়ী।