মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে প্রস্তুত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো হবে। এরইমধ্যে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ধুয়ে মুছে রং ও আলপনায় সাজানো হয়েছে। নেওয়া হয়েছে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
একুশের কর্মসূচি শুরু হবে রাত ১২টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে। এছাড়াও কালো ব্যাজ ধারণ, প্রভাতফেরি সহকারে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও শ্রদ্ধা জানানো হবে। আজ রাত ১২টার পর প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। গত দুই বছর করোনার কারণে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি উপস্থিত থাকতে না পারলেও এবছর সশরীরে শহীদ মিনারে উপস্থিত থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন তারা। এজন্য শহীদ মিনারসহ এর আশপাশের এলাকায় অধিকতর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
সোমবার (২০ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে জাতীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে র্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) এম খুরশীদ হোসেন জানান, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও মহান শহীদ দিবসে সুনির্দিষ্ট কোনো হুমকি নেই। তবে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ সারাদেশের নিরাপত্তা ও নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সর্বোচ্চ নজরদারি থাকবে।
তিনি আরও জানান, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে ২০ ফেব্রুয়ারি দুপুর থেকে যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি রোধে ঢাকাসহ সারাদেশে পর্যাপ্ত র্যাব সদস্য নিয়োজিত রয়েছে। অগ্রিম পদক্ষেপ হিসেবে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সাদা পোশাকে র্যাবের নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া টহলের মাধ্যমে শহীদ মিনার এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার করা হয়েছে।
র্যাব ডিজি বলেন, শহীদ মিনারের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে র্যাবের বোম্ব ডিস্পোজাল ইউনিট ও ডগ সুইপিং দল রাখা হয়েছে। পাশাপাশি যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় র্যাবের স্পেশাল ফোর্স ও হেলিকপ্টার সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রয়েছে। শহীদ মিনারমুখী রাস্তার মোড়গুলোতে চেকপোস্ট স্থাপনের মাধ্যমে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তল্লাশি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নারীরা যেন ইভটিজিংয়ের শিকার না হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
এদিকে, রোববার (১৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে ডিএমপি কমিশনার বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাজধানী জুড়ে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিভিন্ন স্থানে বসানো হবে চেকপোস্ট। চালানো হবে তল্লাশি। এছাড়াও পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাঠে কাজ করবেন। যে কোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সোয়াট, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট ও ডগ স্কোয়াড প্রস্তুত থাকবে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারকে ঘিরে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে জানিয়ে কমিশনার বলেন, প্রতিবছরের ন্যায় এবারও ডিএমপি’র পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে সুদৃঢ়, নিশ্ছিদ্র ও সমন্বিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) মহান একুশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও গত কয়েক বছর ধরে দিবসটি পালিত হচ্ছে। বাঙালি জাতির জন্য এই দিবসটি হচ্ছে চরম শোক ও বেদনার, অনদিকে মায়ের ভাষা বাংলার অধিকার আদায়ের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত। যেকোনো জাতির জন্য সবচেয়ে মহৎ ও দুর্লভ উত্তরাধিকার হচ্ছে মৃত্যুর উত্তরাধিকার-মরতে জানা ও মরতে পারার উত্তরাধিকার। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদরা জাতিকে সে মহৎ ও দুর্লভ উত্তরাধিকার দিয়ে গেছেন।
১৯৫২ সালের এদিনে ‘বাংলাকে’ রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র ও যুবসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ সে সময়ের শাসকগোষ্ঠির চোখ-রাঙ্গানি ও প্রশাসনের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে। মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দুর্বার গতি পাকিস্তানি শাসকদের শংকিত করে তোলায় সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিক গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।
একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি। এদিন দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সঠিক নিয়মে, সঠিক রং ও মাপে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। দিবসটি পালন উপলক্ষে জাতীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনসমূহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আজিমপুর কবরস্থানে ফাতেহা পাঠ ও কোরানখানির আয়োজনসহ দেশের সকল উপাসনালয়ে ভাষা শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনায় প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে।
এছাড়াও দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন উপলক্ষে ঢাকা শহরের বিভিন্ন সড়কদ্বীপ সমূহ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সুবিধাজনক স্থান সমূহে বাংলাসহ অন্যান্য ভাষার বর্ণমালা সম্বলিত ফেস্টুন দ্বারা সজ্জিত করা হয়েছে। একুশের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার এবং ভাষা শহীদদের সঠিক নাম উচ্চারণ, শহীদ দিবসের ভাবগাম্ভীর্য রক্ষা, শহীদ মিনারের মর্যাদা সমুন্নত রাখা, সুশৃঙ্খলভাবে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ ইত্যাদি জনসচেতনতামূলক বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি গণমাধ্যম সমূহ প্রয়োজনীয় প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সংবাদপত্র সমূহে ক্রোড়পত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদানের বিষয়টি বিশেষভাবে উপস্থাপন করা হবে। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো একুশের বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করবে।
মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ দুইদিনব্যাপি বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে একুশের প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুস্পার্ঘ্য অর্পন, সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবনসহ সারাদেশে সংগঠনের সকল কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত করণ ও কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ এবং প্রভাতফেরি। এছাড়াও, ২২ ফেব্রুয়ারি বিকাল তিনটায় বঙ্গবন্ধু আর্ন্তজাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে সভাপতিত্ব করবেন।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, রাষ্ট্রাচার অনুযায়ী একুশের প্রথম প্রহরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের উদ্দেশে কেন্দ্ৰীয় শহীদ মিনারের বেদিমূল প্রস্তুত করার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। যথাসময়ে তা সম্পন্ন হবে। এবছর প্রতিটি সংগঠন, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিপর্যায়েও শহীদবেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে পারবেন।
একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার কিছু সড়ক বন্ধ থাকবে : ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ২০-২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও এর আশপাশের এলাকায় যানবাহন এবং জনসাধারণের চলাচলের ওপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আশপাশের বিভিন্ন সড়কে সোমবার (২০ ফেব্রুয়ারি) বিকেল ৫টা থেকে মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এই বিধিনিষেধ বলবৎ থাকবে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস শান্তিপূর্ণভাবে পালন নিশ্চিত করতে রোববার ডিএমপির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নির্দেশনায় বলা হয়, সোমবার বিকেল ৫টা থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত বকশি বাজার-জগন্নাথ হল ক্রসিং সড়ক, চাঁনখারপুল-রোমানা চত্বর ক্রসিং সড়ক, টিএসসি-শিববাড়ী ক্রসিং সড়ক, উপাচার্য ভবন-ভাস্কর্য ক্রসিং সড়কে প্রবেশ নিষেধ থাকবে। যেসব পয়েন্টে রাস্তা বন্ধ/রোড ডাইভারশন দেওয়া হবে সেগুলো হচ্ছে শাহবাগ ক্রসিং, টিএসসি ক্রসিং, দোয়েল চত্বর ক্রসিং, হাইকোর্ট ক্রসিং, শহিদুল্লাহ হল ক্রসিং, জিমনেশিয়াম মাঠ গেইট, রোমানা ক্রসিং, জগন্নাথ হল ক্রসিং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভাস্কর্য ক্রসিং, নীলক্ষেত ক্রসিং, পলাশী ক্রসিং, বকশি বাজার ক্রসিং, চাঁনখারপুল ক্রসিং।
পলাশী ক্রসিং থেকে শহীদ মিনার হয়ে দোয়েল চত্বর, হাইকোর্ট ক্রসিং, টিএসসি ক্রসিং, শহিদুল্লাহ হল ক্রসিংয়ে হেঁটে চলাচল করা যাবে। ভিআইপিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম মাঠে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঢাবি মোকাররম ভবন মাঠে এবং সর্বসাধারণ নীলক্ষেত ও পলাশী ক্রসিংয়ে গাড়ি পার্ক করতে পারবে।