সদ্যসমাপ্ত রংপুরের ভোট নিয়ে অনিয়মের তেমন অভিযোগ না থাকলেও রাত অবধি ভোট চলা নিয়ে উদ্বিগ্ন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিছুদিন আগে গাইবান্ধায় ভোটে অনিয়মের কারণে পুরো নির্বাচন বন্ধ করার রেশ কাটতে না কাটতেই ভোটারদের উপস্থিতির পরও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে কেন ভোটগ্রহণে বিলম্ব হয়েছে তা খুঁজতে মাঠে নামে ইসি। নির্বাচন কাভার করতে যাওয়া সাংবাদিক, পর্যবেক্ষকরা ইসিকে জানালেন, ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ত্রুটি, আঙুলের ছাপ না মেলা, ভোটাররা ইভিএমে অভ্যস্ত হওয়ায় রাত পর্যন্ত ভোটগ্রহণ করতে হয়েছে।
একইসঙ্গে ইভিএমে ভোট নেওয়ার আগে ভোটার এবং ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা উভয়েরই যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকার কথাও নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করেছেন সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকরা।
গত ২৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত রংপুর সিটির নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার কারণ খুঁজতে ইসির আমন্ত্রণে বুধবার (১১ জানুয়ারি) মতবিনিময় সভায় এসব তথ্য দেন নির্বাচন কাভার করতে যাওয়া গণমাধ্যমকর্মী ও পর্যবেক্ষকরা।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ অন্য কমিশনার, সচিবসহ শীর্ষ কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসাররাও মতবিনিময় সভায় ছিলেন।
গত ২৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৬৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। চার লাখ ২৬ হাজার ৪৭০ জন ভোটারের মধ্যে নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন দুই লাখ ৮০ হাজার ৯৭২ জন।
রসিক নির্বাচনে বিপুল ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। তিনি পান এক লাখ ৪৬ হাজার ৭৯৮ ভোট। অন্যদিকে নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া নৌকা প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ২২ হাজার ২৩৯ ভোট। ভোটের ফলাফলে তিনি চতুর্থ হয়েছেন।
তবে নির্বাচন নিয়ে যতটা না আলোচনা হয়েছে তার চেয়ে বেশি হয়েছে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত ভোটগ্রহণের ঘটনা। যা নিয়ে চিন্তিত ইসি। যা ফুটে উঠেছে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কণ্ঠে।
সিইসি বলেন, ‘ইভিএমে ভোট বিলম্ব হওয়া কমিশনকে উদ্বিগ্ন করেছে। এই অভিযোগটা এর আগে আমরা কখনও পাইনি, এটা আমাদের খুব উদ্বিগ্ন করে তুলল। আলোচনা করে এসব সমস্যা যতটা উত্তরণ করা যায় সেই চেষ্টা করা হবে।’
মতবিনিময়ে যা বলেছেন সাংবাদিকরা
মতবিনিময় সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি টেলিভিশন নিউজ টোয়েন্টিফোরের আরেফিন শাকিল বলেন, ‘রংপুরে ভোট সুষ্ঠু হয়েছে, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু সেখানে ভোটের উৎসবের চাইতে ভোটারের ভোগান্তি বেশি হয়েছে। বয়স্ক ভোটাররা বেশি সমস্যায় পড়েছেন। তারা ইভিএমে সাদা আর সবুজ বাটন চাপতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন। মানুষ ইভিএম নিয়ে কনফিউজড।’ ভোটের আগে ঠিকমতো মগ ভোটিং না বিষয়টিও উল্লেখ করেন এই সাংবাদিক।
একাত্তর টেলিভিশনের তানিয়া রহমান বলেন, ‘ইভিএম নিয়ে মানুষের মধ্যে স্বচ্ছ ধারণার অভাব দেখা গেছে রংপুরে। বেশিরভাগ কেন্দ্রে গিয়ে এটাই নজরে এসেছে।’
চ্যানেল ২৪ এর মুকসিমুল আহসান হিমেল বলেন, ‘রংপুরে অনেক কেন্দ্রে মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলে নাই, মানুষ বিরক্ত হয়ে ভোট না দিয়েই বাড়ি গেছেন। রাত ৯টা পর্যন্ত ভোট দিতে মানুষ কেন্দ্রে ছিল, কিন্তু ভোটদান ছিল ধীরগতির।’
ইভিএম সংরক্ষণে কার্যকর ব্যবস্থা দেখা যায়নি বলেও মনে করেন তিনি।
মতবিনিময় সূত্রে জানা গেছে, যমুনা টিভির রাসেল আহমেদ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ইসিকে বলেন, ‘একজন প্রবীণ ভোটার প্রায় আধঘণ্টা চেষ্টা করেও ভোট দিতে পারেননি।পরে তার নাতি এসে তাকে সহযোগিতা করতে এসে দেখেন- তিনি পছন্দের প্রতীকের বদলে ভিন্ন জায়গায় এরইমধ্যে ভোট দিয়ে ফেলেছেন।’
ইভিএমের ধীরগতির কারণে এই যন্ত্র নিয়ে ভোটারদের মধ্যে বিরূপ ধারণা তৈরি হয়েছে বলে মত দিয়েছেন ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির মাহমুদুল হাসান পারভেজ।
রংপুরের ভোট কাভার করা নিউজ টোয়েন্টি ফোরের আরেকজন সাংবাদিক হাবিবুল ইসলাম বলেন, ‘আঙুল ছাপ না মেলার ঘটনা দিনকে দিন বাড়তে থাকায় ইভিএমের পাশাপাশি ব্যালেটের ব্যবস্থা রাখা জরুরি।’
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, ‘সার্ভার ডাউন হয়ে যাওয়া, ভোটারদের ইভিএমে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রশিক্ষণের অভাব লক্ষ্য করা গেছে। মক ভোটিংও কম হয়েছে। ভোটারদের এজন্য বেশি সময় লেগেছে। আমরা ইভিএমে ভোট দেওয়ার প্রদর্শনী বাড়ানোর জন্য বলেছি।’
হাবিবুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ভোটার এবং যারা ভোটগ্রহণ করবেন তাদের উভয়কে বেশি সময় ধরে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আমাদের একজন পর্যবেক্ষককে কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে। সেটাও আমরা দৃষ্টিতে আনার চেষ্টা করেছি।’
জবাবে ইসির পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়েছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারা বিষয়টি খোঁজ নেবেন। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।’
ভোটের অভিজ্ঞতা জানার পর সিইসি এগুলো নিয়ে কাজ করার কথা জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমাদের এখানে টেকনিক্যাল এক্সপার্ট যারা ছিলেন, মিডিয়া কর্মী যারা ছিলেন, তারা রিয়াল ফ্যাক্টটা তুলে ধরেছেন। এখন টেকনিক্যাল এক্সপার্টদের সঙ্গে কথা বলবো যে, কেন ভোটগ্রহণে বিলম্ব হলো, কেন ফিঙ্গার প্রিন্ট মিললো না এখনও এই বিষয়গুলো সঠিকভাবে জানি না। আমরা গভীরভাবে চিন্তা করবো। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিরূপণ করার চেষ্টা করবো।’