করোনাভাইরাস এর মিউটেশন বা পরিবর্তন হয়েছে। বারবার মিউটেশন হয়ে এটা থেকে যাবে। মিউটেশন হলে টিকারও পরিবর্তন বা হালনাগাদ করতে হয়। কিন্তু বারবার টিকা পরিবর্তন বা হালনাগাদ করা খুব কঠিন কাজ। তাছাড়া বিশ্বের একেক দেশে বা একেক অঞ্চলে একেক ধরনের করোনা প্রভাব বিস্তার করছে বা করবে। তাই এক অঞ্চল বা দেশের টিকা অন্য অঞ্চলে কাজ করবে না।
ফলে করোনা থেকে মুক্তি পেতে হলে স্থানীয়ভাবে প্রত্যেক দেশকে বা অঞ্চলকে টিকা উৎপাদন করতে হবে। বাংলাদেশকেও করোনা থেকে মুক্তি পেতে হলে উৎপাদন করতে হবে নিজস্ব টিকা। বাংলাদেশে যে করোনা আক্রমণ করেছে বা করবে, তা শনাক্ত করে টিকা উৎপাদনের গবেষণাগার রয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশকেও তাদের দেশে করোনার কোন ভাইরাস সংক্রমণ করেছে, তা শনাক্ত করে নিজস্ব টিকা উৎপাদন করতে হবে। আর এটা করলেই করোনা থেকে মুক্তি সম্ভব। এটা করা প্রয়োজন এবং সম্ভবও।
সম্প্রতি এমনটাই দাবি করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অণুজীব বিজ্ঞানী, সার্স ভাইরাসের কিট উদ্ভাবক, করোনাভাইরাস শনাক্তের ‘জি র্যাপিড ডট ব্লট’ কিট উদ্ভাবক ড. বিজন কুমার শীল।
তিনি বলেন, আগে যে ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে, ফাইজার, মেডোনা, জনসন, অ্যাস্ট্রাজেনেকা ইত্যাদি ভ্যাকসিন একটা জায়গায় হয়েছে, সেটা হচ্ছে স্পাইক প্রোটিন। যেহেতু ওই জায়গায় পরিবর্তন হচ্ছে, সেই কারণে ভ্যাকসিনের ইম্প্রুভমেন্ট হওয়া দরকার। সেই পরিবর্তন এখানে পুশ করা দরকার। প্রশ্ন হচ্ছে এই পরিবর্তন তো স্থায়ী নয়। সে আরও পরিবর্তন হচ্ছে। প্রতিদিন তো ভ্যাকসিন পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। ভ্যাকসিন তৈরি করতে সময় লাগে, কমপক্ষে ৩-৪ মাস সময় লাগে। এখন যেটা করা যেতে পারে যে, এই ভাইরাসকে যদি লোকালাইজ বা আমাদের দেশে এই ভাইরাস দেখা যাচ্ছে, আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি, এই ভাইরাস যদি সরাসরি আইসোলেট করে কিল (মৃত) করা হয়, কিল করার পদ্ধতি আছে, হিট দিয়ে বা কেমিক্যাল দিয়ে কিল করার পরে, এটি কিন্তু ভ্যাকসিন তৈরি করা সম্ভব। যেটা খুব ভালো কাজ করে।
ড. বিজন বলেন, এখন আমার দেশে করোনার একটা ভ্যারিয়েন্ট বিরাজ করছে, আমরা ব্যবহার করছি অন্য দেশের ভ্যাকসিন, সেটা খুব ভালো কাজ করবে বলে মনে হচ্ছে না। যার জন্য ভ্যাকসিনও লোকালাইজ হয়ে যাবে। অথবা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান মানে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে যদি একই ভাইরাস থাকে, তাহলে একই ভ্যাকসিন হতে পারে। যা মোটামুটি ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে সুরক্ষা দেবে।
তিনি আরও বলেন, এখন আফ্রিকান যে স্ট্রেইন, সেটা আবার মিউটেশন হতে পারে। তখন কিন্তু এখানে থাকবে না। ভাইরাস যখনই পরিবর্তন হচ্ছে, তখনই ভ্যাকসিন পরিবর্তন করতে হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া জটিল। এখন স্থানীয় ভাইরাস যদি সরাসরি আইসোলেট করে, এটাকে কিল (মৃত) করে, নিজস্ব ভ্যাকসিন তৈরি করে ভ্যাকসিন মানুষকে দেন, তাহলে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এটা করা উচিত। এই জিনিসটা চিন্তা করার সময় এসেছে।
বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে ভ্যাকসিন তৈরি করা খুব কঠিন বিষয় না বলেও মনে করেন ড. বিজন। তিনি বলেন, কারণ এই ভাইরাসের একটা চরিত্র আছে। সেটা হলো এটা খুব দ্রুত গ্রো (বৃদ্ধি পায়) করে। বিএসএল৩ ক্যাটাগরির ল্যাবরেটরি থাকলে সেখানে ভাইরাসকে দ্রুত গ্রো করে হিট ও ক্যামিকেল দিয়ে ইনঅ্যাক্টিভ (নিষ্ক্রিয়) করে ডব্লিউএইচের কিছু প্রসিডিউর আছে, সেই পদ্ধতিতে যদি ভ্যাকসিন তৈরি করা যায় এবং সেটা করা সম্ভব। বাংলাদেশ এটা ইচ্ছা করলেই করতে পারবে।
ড. বিজন বলেন, ২০০৩ সালে আমি যখন সিঙ্গাপুরে কাজ করি, তখন সিঙ্গাপুরে বিএসএল৩ ল্যাবরেটরি ছিল না। এখন ১০টির বেশি হয়েছে। বড় বড় কোম্পানি আছে যারা বিএসএল৩ ল্যাবরেটরি তৈরি করে দিতে পারে ১ থেকে ২ মাসের মধ্যে। শুধু দরকার আমরা এটা করতে চাই কি না। নীতিনির্ধারকরা যদি মনে করেন, এই কাজটা করা উচিত, তাহলেই এটা করা সম্ভব। এটা কোনো রকেট সায়েন্স না। এটা খুব সিম্পল সায়েন্স। আমি যেটা মনে করি, বাংলাদেশে খুব অভিজ্ঞ একটা টিম আছে। মন্ত্রণালয় আছে, উপদেষ্টা কমিটি আছে। কমিটিতে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম স্যার আছেন। তিনি অত্যন্ত অভিজ্ঞ মানুষ। তার নেতৃত্ব বা একটা টিম করে কাজ করলে বিষয়টা খুব সহজে হবে। এক্ষেত্রে প্রো-অ্যাক্টিভ হতে হবে, পোস্ট-অ্যাক্টিভ না।
বাংলাদেশ প্রো-অ্যাক্টিভ হলে এবং চেষ্টা করলে দুই-তিন মাস সময় লাগবে বলেও মনে করেন ড. বিজন। ল্যাবের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ করতে চাইলে তা পারবে। বাংলাদেশে বিএসএল৩ ল্যাবরেটরি কয়েকটা আছে। আইসিডিডিআরবিতে একটা আছে। মহাখালীতে আরেকটা ল্যাবরেটরিতে আছে। এটাকে মেরামত করা যেতে পারে। বিএসএল৩ ল্যাবরেটরি করার জন্য যে ধরনের সরঞ্জাম দরকার, তা ভারতে পাওয়া যায়। খুব ভালো মানের পাওয়া যায়। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন ল্যাবরেটরি। ভারত থেকে নিয়ে আসলে বাংলাদেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব। হয়তো সময় লাগবে, কিন্তু শুরু করতে হবে।