‘আওয়ামী লীগের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আমাদের বাড়িতে আসে। আমাকে না পেয়ে মা-বাবাকে গালাগাল শুরু করে। বাড়িতে থাকা আমার চাচাকে মারধর করতে শুরু করে। ৯০ বছর বয়সি অসুস্থ দাদি এগিয়ে এলেও থামেনি তারা। চাচাকে মারধরের প্রতিবাদ করায় বাবাকে পেছন দিক থেকে ধারালো কিছু দিয়ে আঘাত করে। এতে ঘটনাস্থলেই নিস্তেজ হয়ে যান বাবা। পরে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আর চাচাকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা থানায় নিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এ বিচার আমি কার কাছে দিব? দুনিয়ার কারও কাছে আমি বিচার চাই না। আল্লাহ যেন তাদের বিচার করেন।’ বৃহস্পতিবার বিকালে ওয়ারীর গোপীমোহন বসাক লেনের বাড়িতে কথাগুলো বলছিলেন ওয়ারী থানা যুবদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফয়সাল মাহবুব মিজু। তিনি জানান, বুধবার রাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বাসায় ঢুকে তার বাবা মিল্লাত হোসেনকে (৬৭) আঘাত করে হত্যা করে। আর তার চাচা ৩৮নং ওয়ার্ড গোপীমোহন নবেন্দ্রনাথ ইউনিট বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শাহাদত হোসেন স্বপনকে থানা হেফাজতে নেওয়ার আগে মারধর করা হয়। তবে পুলিশ বলছে, স্ট্রোক করে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়ে মিল্লাত হোসেনের মৃত্যু হয়েছে।
ফয়সাল মাহবুব মিজু বলেন, রাত সোয়া ১২টার দিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আমাদের বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে কেউ দোতলা আবার কেউ নিচে অবস্থান নেয়। ঢুকেই জিজ্ঞেস করতে থাকে, ‘ফয়সাল কোথায়?’ এ সময় বাসার সবকিছু তারা তছনছ করে। দোতলা বাড়ির ছাদেই একটি কক্ষে থাকতেন চাচা স্বপন। তাকে সেখান থেকে নিচে নামিয়ে মারধর শুরু করে। অসুস্থ দাদি ফজিলাতুন্নেছা পারু (৯০) চোখের সামনে ছেলেকে মারধর কোনোভাবেই মানতে পারছিলেন না। এ সময় বাবা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বলেন, ‘খুঁজতে এসেছ শাহাদাতকে। স্বপনকে মারছ কেন? ও কি করেছে?’ এ কারণে তাকেও মারধর করা হয়। একপর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে পড়েন বাবা। আর চাচাকে বাসা থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় কাউন্সিলরের কার্যালয়ে। সেখানেও মারধর করা হয়। পরে তাকে পুলিশে দেওয়া হয়।
তবে মারধরের অভিযোগ সঠিক নয় বলে দাবি ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আহমেদ ইমতিয়াজ মান্নাফীর। তিনি বলেন, ‘যাকে মারধরের কথা বলা হচ্ছে তার বয়স সত্তরের মতো। আর এমন মুরুব্বি মানুষকে মারধর করা হবে, তাও কাউন্সিলর কার্যালয়ে এটা কি হতে পারে? দল যাই করি, দিনশেষে আমরা মানুষ তো।’ যুবদল নেতা মিজু (নিহতের ছেলে) বলেন, এলাকায় কারও সঙ্গে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। আমার এবং চাচা কারও নামে কোনো মামলাও নেই। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনও কেউ বলতে পারবে না কারও সঙ্গে খারাপ আচারণ করেছি। এরপরও শুধু একটি দলকে সমর্থনের জন্য কেউ এমন করতে পারে?
এদিকে স্বামীকে হারিয়ে শোকে পাথর মিজুর মা ফরিদা হোসেন। তিনি বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘সে অসুস্থ হলে আমি মানতে পারতাম । এখন ক্যামনে মানুম? আমার হাতের ওপরে মরে গেল, এটা আমি কেমনে মানমু? আমি তো মানতে পারতাছি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘তারা এত লোক ঘরে ঢুকেছে যে, দাঁড়ানোরও জায়গা ছিল না। তাদের হাতে ছিল লাঠিসোটা। মুখ রুমাল দিয়ে ঢেকে, মাস্ক পরে বাসায় ঢোকে তারা।’
নিহত মিল্লাত হোসেনরা সাত ভাই। সর্বকনিষ্ঠ ভাই মো. শরীফ উদ্দিন সাগর। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন তিনিও। সেই ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘তাদের আঘাতে একপর্যায়ে দেখলাম ভাইয়ের পেছন দিক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর তিনি নিস্তেজ হয়ে গেলে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখান থেকে আজগর আলী হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে মিটফোর্ড হাসপাতালে নেই।’ ঘটনার সময় এলাকায় ‘টাইগার’ নামে পরিচিত এক ব্যক্তিকে দেখেছি। তবে অন্যদের শনাক্ত করতে পারিনি। যাওয়ার সময় তারা পাশের ভবনের সিসিটিভি ফুটেজও নিয়ে গেছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের ওয়ারী জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) কামরুল ইসলাম বলেন, ওই ব্যক্তির বয়স সত্তরের মতো। তিনি স্ট্রোক করেছেন। কিন্তু সেই রাতে কী ঘটেছিল তা সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু এখনো বোঝা যাচ্ছে না। কারণ ওই ব্যক্তির মৃত্যুর পর এখনো কেউ থানায় এসে অভিযোগ করেনি। এদিকে ঘটনার রাতে মিজুর বাসায় প্রবেশ করা ব্যক্তিরা অজ্ঞাত বলে জানান ওয়ারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কবির হোসেন। নয়াপল্টনে সংঘর্ষের ঘটনায় শাহাদতের জড়িত থাকার সত্যতা না পেয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। থানায় কেউ মামলা করতে না যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ফয়সাল মাহবুব মিজু বলেন, ‘ঘটনার আকস্মিকতায় পুরো পরিবার ভেঙে পড়েছে। আর মামলা করব কোথায়? পুলিশ তো তাদেরই অংশ হয়ে গেছে।’