ডলার সংকটের কারণে শিল্পের উপকরণ আমদানির নতুন এলসি খোলা ভয়ানকভাবে কমে গেছে। এতে আগামীতে শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি কম হবে। ফলে শিল্প উৎপাদনও কমবে। একই সঙ্গে রপ্তানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ‘ব্যাক টু ব্যাক এলসি’ও কমেছে।
এ খাতে ডলারের সংকট না হলেও রপ্তানির আদেশ কম আসায় কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা হচ্ছে কম। ফলে রপ্তানিও কমে যাবে। এছাড়া শিল্প খাতে গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন জোগানেও সংকট রয়েছে। এতেও শিল্প উৎপাদন কমছে। তবে আগে খোলা এলসির পণ্য এখন দেশে আসায় আমদানি কিছুটা বেড়েছে।
এতে ১-২ মাস চলবে। এরপরই সংকট প্রকট হবে-এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, এসব কারণে আগামীতে শিল্প খাতে বড় সংকট হতে পারে। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণেও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণেও শিল্পের উপকরণ আমদানি কমে গেছে। কারণ চড়া দামে পণ্য আমদানি করে সেগুলো বিক্রি করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। এর বাইরে বিদ্যমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে।
যে কারণে তারা নতুন বিনিয়োগেও যেমন যাচ্ছেন না, তেমনি চলমান ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ নীতি সংকোচন করার ফলে নতুন উদ্যোগ বাস্তবায়নে খরচ বেশি হবে। কেননা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের সুদের হার দুই দফায় বাড়িয়ে ২ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশ করেছে। এছাড়া কয়েকটি তহবিলের সুদের হারও বাড়ানো হয়েছে।
ব্যাংকগুলোতে রয়েছে তীব্র ডলার সংকট। এজন্য ডলারের সংস্থান ছাড়া কোনো উদ্যোক্তারা এখন এলসি খুলতে পারছেন না। কেবল রপ্তানিকারকরা ডলার সংস্থান করতে পারছেন। ফলে তারা এলসি খুলতে পারছেন। তবে পণ্যের দাম বাড়ায় রপ্তানি আয়ের পুরো অর্থ দিয়েও এখন চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে পারছেন না।
ফলে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। আগে তারা রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ এলসি খোলায় ব্যবহার করতেন। বাকি ২০ শতাংশ নিজেদের প্রয়োজনে কাজে লাগাতেন। এখন সেটি সম্ভব হচ্ছে না। এর বাইরে রেমিট্যান্স দিয়ে সরকারি খাতের ও অত্যাবশ্যকীয় কিছু পণ্যের এলসি খোলা হচ্ছে। এর বাইরে অন্য উদ্যোক্তারা ডলারের সংস্থান করতে পারছেন না বলে এলসিও খুলতে পারছেন না।
রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করা হয় ‘ব্যাক টু ব্যাক’ এলসির মাধ্যমে। গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ব্যাক টু ব্যাক এলসি কমেছে ২৭ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ১৪ শতাংশ। ফলে আগামীতে এর আওতায় কাঁচামাল আমদানি কমে যাবে।
আগে খোলা এলসির পণ্য দেশে আসায় আমদানি বেড়েছে। গত অর্থবছরে ব্যাক টু ব্যাক এলসি বেড়েছিল ৪০ শতাংশ ও আমদানি বেড়েছিল ৫৭ শতাংশ। অনেক উদ্যোক্তা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কাঁচামাল আমদানি করে সেগুলো ছোট উদ্যোক্তাদের কাছে বিক্রি করেন। তারা এগুলো কিনে ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। বাণিজ্যিক আমদানিকারকদের নিজস্ব কোনো ডলারের উৎস নেই। ব্যাংকই তাদের ভরসা। কিন্তু ব্যাংক এখন ডলারের জোগান দিতে পারছে না। ফলে তারা এলসি খুলতে পারছেন না।
এতে খোলাবাজার থেকে পণ্য কিনে যেসব ছোট উদ্যোক্তা শিল্প চালাতেন, তারা এখন কাঁচামাল সংকটে ভুগছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠান রপ্তানি খাতে ও বড় শিল্পগুলোতে নানা পণ্যের জোগান দেয়। ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাঁচামাল সংকটের কারণে রপ্তানি ও বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোও ক্ষতির মুখে পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বাণিজ্যিকভাবে শিল্প উপকরণ আমদানির এলসি বেড়েছে মাত্র ২ শতাংশ। একই সময়ে আগের খোলা এলসি নিষ্পত্তি হওয়ায় আমদানি বেড়েছে ৪১ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে এলসি খোলা বেড়েছিল ৫৮ শতাংশ এবং আমদানি বেড়েছিল ৬১ শতাংশ। গত অর্থবছরের তুলনায় এ খাতে এলসির প্রবৃদ্ধি কমেছে ৫৬ শতাংশ এবং আমদানি ২০ শতাংশ কমেছে।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, শিল্পের উপকরণ আমদানি কমার প্রধান কারণ ডলার সংকট। দ্বিতীয় কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি এবং তৃতীয় কারণ অনেকে মনে করেন বাড়তি দামে পণ্য কিনে বিক্রি করা যাবে না। শিল্পের উপকরণের এলসি খোলা কমার কারণে এ খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এটাই স্বাভাবিক।
এখন অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। তাহলে কিছু শিল্প ভালো থাকবে। এগুলোতে কর্মসংস্থানও হবে। অন্যান্য শিল্পের বিষয়ে এখন টিকে থাকার নীতি গ্রহণ করতে হবে। রপ্তানির ক্ষেত্রে যেসব দেশে মন্দার আঘাত কম ওইসব দেশে নজর দিতে হবে। এবারের সংকটের মূল কারণ হচ্ছে বৈশ্বিক। এর মধ্যে দেশে ডলার সংকট এ মন্দাকে প্রকট করেছে। এখন রেমিট্যান্সের দিকে বেশি জোর দিতে হবে। রেমিট্যান্স বাড়লে ও আমদানি কমলে ডলারের সংকট কমবে। তবে শিল্প খাতের আমদানি কমানো ঠিক হবে না।
সূত্র জানায়, দেশে শিল্প খাতের মৌলিক কাঁচামালের পাশাপাশি মধ্যবর্তী কাঁচামালও আমদানি হয়। বিশেষ করে কিছু শিল্প মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি করে সেগুলো দিয়ে পণ্য উৎপাদন করে। যেমন গার্মেন্ট শিল্পের সুতা, কাপড় মধ্যবর্তী কাঁচামাল। এগুলো দিয়ে পোশাক তৈরি করে রপ্তানি করা হয়। এ রকম আরও অনেক মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি করা হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের ওই সময়ে শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানির এলসি কমেছে ১৫ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ৩ শতাংশ। এর মধ্যে সিমেন্টের এলসি কমেছে ৫৩ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ৬ শতাংশ। বিপি শিটের এলসি কমেছে ৬০ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ৭৪ শতাংশ। টিন প্লেটের এলসি ও আমদানি দুটোই কমেছে।
এলসি ৭১ শতাংশ এবং আমদানি ৬৪ শতাংশ কমেছে। স্ক্র্যাব ভেসেলের এলসি ও আমদানি দুটোই কমেছে। এলসি ৫৬ শতাংশ এবং আমদানি ৭০ শতাংশ কমেছে। মেটালে এলসি ও আমদানি দুটোই কমেছে। এলসি ৫৮ শতাংশ এবং আমদানি ৫৩ শতাংশ কমেছে। পোপার এবং পেপার বোর্ডে এলসি কমেছে ৪০ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে মাত্র দশমিক ৪২ শতাংশ। অন্যান্য মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানির এলসি কমেছে ১২ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ২৯ শতাংশ।
গত অর্থবছরের ওই সময়ে মধ্যবর্তী কাঁচামালের এলসি ২৯ শতাংশ ও আমদানি ৩৫ শতাংশ বেড়েছিল। ওই প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, আলোচ্য সময়ে শিল্পের মৌলিক কাঁচামালের এলসি কমেছে ১৫ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ২৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের ওই সময়ে মৌলিক কাঁচামালের এলসি ৩৭ শতাংশ এবং আমদানি ৪৭ শতাংশ বেড়েছিল। মৌলিক কাঁচামালের মধ্যে বীজের এলসি কমেছে ৩৬ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। টেক্সটাইল ফেব্রিক্সের এলসি কমেছে ১৯ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ১৯ শতাংশ।
কটন ইয়ার্নেও এলসি ও আমদানি দুটোই কমেছে। এর মধ্যে এলসি ৫৮ শতাংশ এবং আমদানি ৩ শতাংশ কমেছে। কোপরার এলসি ও আমদানি দুটোই কমেছে। এর মধ্যে এলসি ৪৫ শতাংশ ও আমদানি ২৮ শতাংশ কমেছে। সিনথেটিক সুতার এলসি কমেছে ৪১ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে সাড়ে ৩ শতাংশ। বস্ত্র খাতের মৌলিক কাঁচামাল তুলার এলসি খোলা কমেছে ৩০ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ৪৩ শতাংশ।
ওষুধের অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৯৮ শতাংশই দেশীয় কোম্পানিগুলো মিটিয়ে থাকে। বিদেশে রপ্তানিও হচ্ছে। ফলে এ খাতে ডলারের সংকট তেমন একটা নেই। তবে যারা রপ্তানি করতে পারছেন না তারা ডলার পাচ্ছেন না। এছাড়া পণ্যের দাম বাড়ায় অনেকে এলসি খুলছেন না। তাছাড়া মন্দায় চাহিদাও কমেছে। এসব কারণে নতুন এলসি খোলা কমেছে। ওষুধের কাঁচামালের এলসি ও আমদানি দুটোই কমেছে। এলসি ২২ শতাংশ ও আমদানি ৮ শতাংশ কমেছে। একই সঙ্গে ওষুধ শিল্পের যন্ত্রপাতির এলসি কমেছে ৩১ শতাংশ, আমদানি কমেছে ৩৬ শতাংশ। ফলে এ শিল্পের নতুন কারখানা স্থাপন ও চালু কারখানার আধুনিকায়নের গতিও মন্থর।
নতুন শিল্প স্থাপন ও চালু শিল্পের কলেবর বাড়াতে বা আধুনিকায়নে যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হয়। গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে যন্ত্রপাতির এলসি কমেছে ৬৮ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ৫৭ শতাংশ। বিবিধ শিল্পের যন্ত্রপাতির এলসি ও আমদানি দুটোই কমেছে। এর মধ্যে এলসি ২৯ শতাংশ ও আমদানি ১ শতাংশ কমেছে।
গত অর্থবছরের ওই সময়ে যন্ত্রপাতির এলসি ১৪ শতাংশ ও আমদানি ৪১ শতাংশ বেড়েছিল। বিবিধ শিল্পের যন্ত্রপাতির এলসি ১৭ শতাংশ ও আমদানি ২৮ শতাংশ বেড়েছিল। তবে পাট ও চামড়া শিল্পের যন্ত্রপাতির আমদানি বেড়েছে। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ এসব শিল্পের নতুন কারখানা হচ্ছে না। রপ্তানিতেও মন্দা। তারপরও কেন এসব শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়ছে।
শিল্পের যন্ত্রপাতির মাধ্যে টেক্সটাইল মেশিনারিজের এলসি কমেছে ৮০ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ২০৬ শতাংশ। চামড়া শিল্পের এলসি কমেছে ৫৮ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ১৩৩ শতাংশ। পাট শিল্পের এলসি কমেছে ৮৬ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ৬৩ শতাংশ। গার্মেন্ট খাতের এলসি কমেছে ৭৭ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ২৯ শতাংশ। প্যাকেজিং শিল্পের এলসি কমেছে ৭১ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ১৯৬ শতাংশ। অন্যান্য শিল্পের এলসি কমেছে ৬৩ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ৫৯ শতাংশ।
শিল্প খাতের বিবিধ যন্ত্রপাতির মধ্যে মেরিন ডিজেল ইঞ্জিন এলসি কমেছে ৭৮ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ১৫৫ শতাংশ। কম্পিউটার ও এর উপকরণ এলসি ৫৫ শতাংশ ও আমদানি ১৫ শতাংশ কমেছে। শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে গাড়ি ও এর যন্ত্রাংশ এলসি কমেছে ৩২ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ১৭ শতাংশ। অন্যান্য আয়রনে ও স্টিল পণ্য এলসি কমেছে ২২ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ৭৪ শতাংশ। কৃষি খাতের যন্ত্রপাতি ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারের এলসি ৫৩ শতাংশ ও আমদানি ৩২ শতাংশ কমেছে। অন্যান্য যন্ত্রপাতির এলসি ৩০ শতাংশ ও আমদানি ২ শতাংশ কমেছে।
হাতেগোনা কয়েকটি শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ও এলসি বেড়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ব্যবহৃত কয়লার এলসি ১৬ শতাংশ ও আমদানি ২৫ শতাংশ বেড়েছে। সিমেন্ট শিল্পের ক্লিকার ও লাইম স্টোনের এলসি ১০ শতাংশ ও আমদানি ৩৬ শতাংশ। আইরন অ্যান্ড স্ক্র্যাপের এলসি আড়াই শতাংশ ও আমদানি ১৫ শতাংশ বেড়েছে। অপরিশোধিত ভোজ্যতেলের এলসি ১৮৯ শতাংশ ও আমদানি ৩১০ শতাংশ বেড়েছে রাসায়নিক পণ্যের এলসি ২৯ শতাংশ ও আমদানি ৫০ শতাংশ বেড়েছে।