দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষের জন্য একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির কারণে চিকিৎসার জন্য রোগীদের নির্ভর করতে হচ্ছে মূলত ইন্টার্ন চিকিৎসক ও নার্সদের ওপর। অভিযোগে জানা গেছে, মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপকদের হাসপাতালমুখী করা যাচ্ছে না। হাসপাতালের পরিচালক ও কলেজের প্রিন্সিপাল এ বিষয়ে লিখিতভাবে অফিস আদেশের মাধ্যমে বিষয়টি তাদের অবহিত করলেও তারা তাতে কর্ণপাত করছেন না। যেসব অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক বিগত কয়েক বছর ধরে এ হাসপাতালের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে বরিশাল নগরীতে ক্লিনিক, ডায়ানগস্টিক সেন্টার গড়ে তুলেছেন, তাদের কোনোভাবেই পাওয়া যায় না। যারা অপেক্ষাকৃত কম সময় ধরে রয়েছেন অথবা নাম-ডাক কম করেছেন, তাদের অনেকে মেডিক্যালে এসে রোগীদের দেখার নামে বাইরে নামে-বেনামে গড়ে তোলা ক্লিনিক কিংবা ডায়াগনস্টিকের প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন।
অসহায় রোগীরা বাধ্য হয়ে এসব চিকিৎসকের কথা মেনে বাইরের বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকে গিয়ে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। গরিব অসহায় রোগীদের মধ্যে যাদের প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসার সামর্থ্য নেই, তাদের চেম্বারে গিয়ে দেখা করতে বলা হয়। চেম্বারে ভিজিটসহ পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ না করলে সেই রোগী মেডিক্যালে কোনোভাবেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাক্ষাত পান না। যারা এসব করতে পারেন না, তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারসহ নানান সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে রোগীদের হাসপাতাল ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এতে করে কাগজে কলমে ১ হাজার বেডের এ মেডিক্যালের ৩৭টি ওয়ার্ডে দৈনিক গড়ে ২ হাজার রোগীকে চিকিৎসা নিতে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শের-ই-বাংলা মেডিক্যালকে পুঁজি করে চিকিৎসক থেকে শুরু করে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পর্যন্ত সকলের সমন্বয়ে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়েছে। আর মেডিক্যালে ভর্তি হওয়া রোগীরা এ শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েও প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। ওয়ার্ডগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, প্রত্যেক ওয়ার্ডে শিফট ভাগ করে দায়িত্বরতরা নিজেরাই নিয়ম-কানুন তৈরি করে রেখেছেন। রোগী ভর্তি থেকে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত সব কার্যক্রম দেখভালে থাকা ট্রলিবয় থেকে সকল পর্যায়ে চলে বাণিজ্য। ছুটির দিন ব্যতীত দিনের বেলায় হাসপাতালের পরিচালকসহ অন্যরা থাকায় রোগী ও স্বজনরা দৌড়ঝাঁপ কিংবা বিভিন্ন পরিচয়ে সামান্যতম চিকিৎসাসেবা পেলেও বিকালের পর পুরো হাসপাতাল চলে যায় এসব অসাধু কর্মচারীদের দখলে। কেননা হাসপাতালের শীর্ষ কর্মকর্তারা বারবার চিঠি দিয়ে প্রত্যেক ইউনিটের সহকারী অধ্যাপক পদমর্যাদার একজনকে প্রধান করে সান্ধ্যকালীন পরিদর্শনের যে সুপারিশ করেছেন, তার কোনো কার্যকারিতা নেই। দুপুর ২টার পর চিকিৎসকরা হাসপাতাল ত্যাগ করার পর থেকেই হাসপাতালের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাণিজ্যের মাত্রা আরও বাড়তে থাকে। ইন্টার্ন কিংবা নার্সদের সেবা পেতেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগী ও স্বজনদের নানান ব্যক্তির দ্বারস্থ হতে হয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বিশেষ কারো পরিচয় ছাড়া (আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সেনাবাহিনী, প্রশাসন কিংবা সাংবাদিক) সেবা মেলে না। মুমূর্ষু রোগীদের স্বজনরা চিকিৎসাসেবা না পেয়ে প্রায়ই ইন্টার্ন চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে সংঘাতে জড়াচ্ছেন। হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচ এম সাইফুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপকগণ তার অধীনে না থাকলেও মেডিক্যালে রুটিন করে রোগী দেখা তাদের দায়িত্ব এবং এ বিষয়টি তিনি বারবার তাদের জানিয়েছেন। এক বছর ধরে সকাল ৯টায় এবং সন্ধ্যায় সুবিধাজনক সময়ে সব অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপককে হাসপাতালে এসে নিয়মিত রোগীদের চিকিৎসা দিতে অনুরোধ করে চিঠি দেন তিনি। কিন্তু কেউ তাতে কর্ণপাত না করায় পরবর্তীতে কলেজের অধ্যক্ষসহ তিনি যৌথ স্বাক্ষরে চিঠি দেন। কিন্তু তাতেও সুফল মিলছে না।
তিনি বলেন, মুমূর্ষু রোগীদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রয়োজন, ইন্টার্ন চিকিৎসকের সেবায় তাদের সন্তুষ্ট হওয়ার কথা নয়। বরিশাল সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সভাপতি প্রফেসর শাহ সাজেদা বলেন, মেডিক্যালের সব পর্যায়ে অনিয়ম-দুর্নীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সেখানে ধারাবাহিকভাবে একটানা ১৫ দিন দুদক অথবা শক্তিশালী কোনো সরকারি সংস্থার অবস্থান করা প্রয়োজন। তাতে যদি কিছুটা অনিয়ম কমানো সম্ভব হয়। এছাড়া এ হাসপাতালের পরিচালক পদে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কেউ দায়িত্ব পেলে শৃঙ্খলা রক্ষার কাজটি অনেক সহজ হতো।