র্যাবের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা দুই দেশের সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর র্যাব ও তার সাতজন সিনিয়র কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র। নিষেধাজ্ঞার কারণ সম্পর্কে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিষেধাজ্ঞার পটভূমি রচিত হয় চার বছর অগে। ২০১৮ সালে র্যাবকে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা বন্ধ করার মাধ্যমে প্রক্রিয়াটির সূত্রপাত হয়েছিল। ওই সময়ে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস বিষয়টির পরিণতি সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারকে অন্ধকারে রেখেছিল।
ফলে বিষয়টি নিয়ে কোনো প্রকার কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হয়নি। অনেকে এই নিষেধাজ্ঞাকে বর্তমান সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের বৈরী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে বিবেচনা করে থাকেন। কেন এই নিষেধাজ্ঞা এলো, কাদের মদদে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলো, কাদের ব্যর্থতার কারণে নিষেধাজ্ঞা এলো তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। বাইডেন সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ, চীনের প্রতি অতিরিক্ত ঝুঁকে পড়ার জন্য বাংলাদেশকে শাস্তি দেওয়া থেকে শুরু করে বিএনপি-জামায়াতের লবিংকে এই নিষেধাজ্ঞার জন্য দায়ী করা হয়েছে।
সম্প্রতি বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতীয়মান হয় যে, র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার পটভূমি তৈরি হয় ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের ভিতরকার প্রায় তিন বছর সময়ে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র র্যাব প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে শুরু করে দীর্ঘদিন ধরে র্যাবের সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ডকে সমর্থন জুগিয়েছিল। ২০১৮ থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার র্যাবের কিছু কর্মকান্ডবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দমনের প্রেক্ষাপটে দেখতে শুরু করে। এই মার্কিনি মনোভাব পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী সরকার বিরোধী বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর নিবিড় জনসংযোগ এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রচারণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব তৎপরতার ফলে ১০ জন মার্কিন সিনেটর ২০২০ সালের ২৭ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সেক্রেটারি অব স্টেট মাইক পম্পেও এবং ট্রেজারি সেক্রেটারি স্টিভেন মুন্সিনকে লেখা চিঠিতে র্যাবের সিনিয়র কমান্ডারদের বিরুদ্ধে ‘টার্গেটেড স্যাংশন’ আরোপের অনুরোধ জানায়।
ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান সিনেটরদের স্বাক্ষরিত এই চিঠির নেতৃত্বে ছিলেন সিনেট ফরেন রিলেশন্স কমিটির তৎকালীন র্যাংকিং মেম্বার বব মেনেন্ডেজ, যিনি ২০২১ থেকে সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির চেয়ারম্যান পদ লাভ করেন। চিঠির একটি কপি যুগান্তরের হাতে রয়েছে। কার্যত এই চিঠি প্রশাসনের হাতে যাওয়ার পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আসন্ন নিষেধাজ্ঞা প্রতিরোধের সুযোগ সামান্যই ছিল। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্লাটফর্মের ওপর ভিত্তি করে সদ্য নির্বাচিত বাইডেন প্রশাসন সিনেটের অনুরোধকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছিল।
যে কারণে তারা ঢাকায় বা ওয়াশিংটনে র্যাব নিয়ে আর কোনো আলোচনা বা প্রশ্ন উত্থাপন না করে সরাসরি ১০ ডিসেম্বর র্যাপের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র র্যাবকে সহযোগিতা বন্ধ করার পর থেকে ২০২০ এর অক্টোবর মাসে সিনেটরদের চিঠি লেখার সময় পর্যন্ত তিন বছর ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। র্যাবের কর্মকাণ্ড তথা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে ওয়শিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস কীভাবে ব্রিফ করেছিল তা পরিষ্কার নয়।
ওই সময়ে কর্মরত কূটনীতিকদের সূত্রে জানা গেছে, ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের তরফে ‘ব্যাড নিউজ’ সরকারকে জানানো হতো না। র্যাবসংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষ বা উদ্বেগের কথা সরকারের উচ্চ মহলকে অবহিত করা হয়নি বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মনোভাব জানার জন্য দেশটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আরও বাড়ানো দরকার। কোভিড মহামারির কারণে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালের মার্চ থেকে আগস্ট এই ছয় মাসের ভিতরে পার্টনারশিপ ডায়লগ, ইকোনমিক কন্সালটেশন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সংলাপ, সংসদীয় কমিটির সফর ও মার্কিন বিজনেস ডেলিগেশনের বাংলাদেশ সফর অনুষ্ঠিত হয়। এসব বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত থাকা র্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে ইতিবাচক হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। সূত্র মতে, চীনের উত্থান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশকেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে।