তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ বিভিন্ন দাবিতে বিএনপির গণসমাবেশ কর্মসূচিতে মানুষের উপস্থিতি নিয়ে চিন্তিত আওয়ামী লীগ সরকারের নীতিনির্ধারকরা। প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও তাদের অনেকেই বলছেন, সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রচার তেমন কাজে আসছে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি, সার, জ্বালানি তেল ও গ্যাস সংকট, দুর্নীতিসহ বিদ্যমান পরিস্থিতি সরকারের সাফল্যকে কিছুটা হলেও ম্লান করছে। দেশবাসী সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সুফল ভোগ করলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকেই নেতিবাচক দিকগুলোই সামনে আনছেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এসব কারণেই বিএনপির বিভিন্ন সমাবেশে উপস্থিতি বাড়ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা উদাহরণ দিয়ে বলেন, পদ্মা সেতুর প্রধান উপকারভোগী বরিশাল বিভাগের মানুষ। সারা দেশের মানুষই নানাভাবে এর সুফল ভোগ করছে। তবে বিশেষভাবে সুবিধা পাচ্ছেন বরিশাল বিভাগবাসী। এর আগে রাজধানীর সঙ্গে সড়কপথে সহজ যোগাযোগে তাদের আর কোনো পথ ছিল না। এখন সেই সুযোগ তৈরি হয়েছে। দেশের উন্নয়নের বিষয় মাথায় রেখে নানা প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণ কাজ শেষ করে। খুব বেশি দিন আগে এর উদ্বোধন হয়নি। সেই বরিশালেই সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি হিসাবে বিএনপি গণসমাবেশ করে। এতে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীসহ সাধারন দুস্থ মানুষের ঢল নামে।
পরিবহণ বন্ধের কারণে দুদিন আগে থেকেই মানুষ সমাবেশস্থলে হাজির হয়। এক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর সাফল্য তেমন কাজে আসেনি। বিএনপি প্রায় একই ধরনের বড় সমাবেশ করেছে দেশের আরও পাঁচ বিভাগে। প্রতিটি সমাবেশেই নেতাকর্মীদের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ যোগ দিয়েছেন। নেতাকর্মীদের বাইরে সাধারণ মানুষগুলোর কথা হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তারা দিশেহারা। কোনোভাবেই বাজারের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন না। সমাবেশে বক্তৃতার সঙ্গে তাদের বর্তমান অবস্থা মিলে যাচ্ছে। সে কথাই তারা শুনতে এসেছেন। গণসমাবেশে উপস্থিতি এবং মানুষের এ ধরনের মনোভাবই সরকারকে ভাবিয়ে তুলছে। আগামী দশ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগে আরও চারটি সমাবেশ হবে।
পদ্মা সেতুর মতো আরও অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। সম্প্রতি একশ সেতু উদ্বোধন হয়েছে। আগামীতে মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা বন্দরসহ উন্নয়ন প্রকল্পগুলো উদ্বোধন হবে। এর প্রতিটির উপকারভোগী সাধারণ মানুষ। এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রচার কিভাবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন নীতিনির্ধারকরা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী রোববার যুগান্তরকে বলেন, এখানে সরকারের কোনো ব্যর্থতা আছে বলে তিনি মনে করেন না। দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে। আগে জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি, এখন হয়েছে ১৭ কোটি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার উন্নয়নের কারণে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়েছে। কম সময়ে মানুষ যেতে পারছেন যে কোনো স্থানে। সে জন্য বিএনপির সমাবেশগুলোতে তাদের নেতাকর্মীরা যেতে পারছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিক মানুষ। কোনো প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না। এ কারণে বিএনপির নেতাকর্মীরা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করছে।
এর আগে রাজধানী ঢাকায় এক সরকারি অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের স্বীকার করেন বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে লোক সমাগম নিয়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা সঠিক তথ্য তুলে ধরছেন না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশগুলো ফ্লপ নয় বলেও মনে করেন তিনি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জানান, অভাব ও কষ্টে রয়েছে এ ধরনের কিছু মানুষ বিএনপির সভা-সমাবেশে অংশ নিচ্ছেন।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ রোববার যুগান্তরকে বলেন, বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে লোকজনের উপস্থিতি দেখে বিএনপি বেশ অনুপ্রেরণা পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। একই সঙ্গে এই উপস্থিতির কারণে বিএনপিকে নিয়ে সরকার খুবই আতঙ্কিত। দুদিন আগে থেকে পরিবহণ বন্ধ না করলে বিএনপির এসব সমাবেশে আরও ২ থেকে ৩ গুণ বেশি মানুষ উপস্থিত হতো।
সরকার সংশ্লিষ্টরা নাম প্রকাশ না করে যুগান্তরকে বলেন, পদ্মা সেতুসহ সরকারের সব বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের প্রচার কাজে আসছে না। বিএনপির সমাবেশে উপস্থিতি ঠেকাতে বিভিন্ন কৌশল নেওয়া হলেও মানুষ যাচ্ছেই। এমনকি কর্মসূচির আগেই ভেন্যুতে গিয়ে পৌঁছছে দলটির নেতাকর্মী, সমর্থক এমনকি সাধারণ মানুষ। কোনো বাধাতেই তাদের আটকানো যাচ্ছে না। এই স্বতঃস্ফূর্ততা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতিতে সরাসরি জিয়া পরিবারের অনুপস্থিতিতে বিএনপিকে এতদিন নেতৃত্বহীন ভাবা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীরা সংগঠিত হয়ে আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক রোববার যুগান্তরকে বলেন, বিএনপির সমাবেশে কেমন লোক হচ্ছে তা দিয়ে তাদের জনপ্রিয়তা প্রমাণ হয় না। এর মাধ্যমে বিএনপিসহ কোনো মহল যদি সরকারের ব্যর্থতা খুঁজে তাহলে তারা ভুল করছে। জনপ্রিয়তা প্রমাণের একটিই পথ নির্বাচন। তাই তিনি আশা করেন, বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসে তাদের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ রোববার যুগান্তরের কাছে দাবি করেন, বিএনপির এসব সমাবেশে সাধারণ মানুষের কোনো অংশগ্রহণ নেই। তার মতে, ‘এসব সমাবেশে বিএনপির নেতাকর্মীরাই যাচ্ছে। এর বাইরে কেউ নয়। কারণ বিএনপিকে সাধারণ মানুষ চায় না। তারা দেশের কল্যাণের জন্য অতীতে কোনো কাজ করেনি।’ তিনি বলেন, আমরা যদি চট্টগ্রামের কথা ধরি, সেখানে মহানগর ও জেলা মিলিয়ে প্রায় ৯১ লাখ মানুষ বসবাস করেন। এর ১০ ভাগের সমর্থন পেলে বিএনপি ৯১ হাজার মানুষকে পায়। এই সংখ্যাটি দিয়ে তাদের সমাবেশে মানুষের বিপুল উপস্থিতি প্রমাণ হয় না।
এদিকে শুক্রবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের যুব মহাসমাবেশ সফল করতে ঘাম ঝরেছে সরকার সমর্থকদের। ‘যুব মহাসমাবেশ’ নাম দিয়ে ডাকা যুবলীগের এই শোডাউনে আগে থেকে প্রস্তুতি নেয় আওয়ামী লীগসহ সব সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন। প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিকে বার্তা দিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত যুবলীগের যুব মহাসমাবেশটি শেষ পর্যন্ত সরকারি দল আওয়ামী লীগের জমায়েতে পরিণত হয়। এ জমায়েত সফল করতে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের দুই অংশ রাজধানীর প্রতিটি ইউনিট থেকে কমপক্ষে ১০০ করে মানুষের উপস্থিতি নিশ্চিতের আগাম নির্দেশ দেয়। কিন্তু কী কারণে সরকারের সব বড় বড় উন্নয়ন কাজের প্রচারের পরও বিএনপির সমাবেশে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি? এর পেছনে কি অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে? সেই প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করছেন সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা।
যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক বলেন, করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশের মানুষের জীবনে যে সংকট তৈরি হয়েছে তা কাজে লাগাচ্ছে বিএনপি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানি তেলসহ ব্যবহার্য সব জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ প্রতিকূল সময় পার করছে। মোট কথা জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় কষ্টে আছে দেশের মানুষ। বৈশ্বিক এই সংকটকে সরকারের ব্যর্থতা দেখিয়ে মানুষের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করছে বিএনপি।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এসব নেতার মতে, বর্তমান পরিস্থিতির মূলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং অবশ্যই বৈশ্বিক সংকট হলেও নিজেদের দায় একেবারেই নেই তা নয়। সরকারের ভুল নীতি, দুর্নীতি, দেশ থেকে টাকা পাচার এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দূরত্ব বৃদ্ধি সংকট আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিছু ব্যবসায়ীর স্বার্থে সরকার আমদানিনির্ভর জ্বালানি নীতি গ্রহণ করেছে। দেশের গ্যাস উত্তোলনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ কারণে গভীর সংকটে পড়েছে শিল্পখাত। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের কষ্ট সীমাহীন। একজন আওয়ামী লীগ নেতা স্বীকার করেন, দেশ সংকটে পড়লে সরকার সমালোচিত হয়, এটা স্বাভাবিক। প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি সেই সুযোগ নিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।