জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রতি বছরের মতো এবারও শুরু হয়েছে জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৭)। ৬ নভেম্বর থেকে সম্মেলনটি শুরু হয়েছে মিশরের লোহিত সাগরের তীরবর্তী অবকাশকেন্দ্র শার্ম আল শেখে। এবারের সম্মেলনের দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে আফ্রিকার দেশগুলো। তাপমাত্রা বৃৃদ্ধির জন্য দায়ী কার্বন নিঃসারণের জন্য মহাদেশটির ভূমিকা বেশি না হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিরাট মাশুল দিতে হচ্ছে সেখানকার দেশগুলোকে। চলতি বছর প্রলয়ংকরী বন্যায় পশ্চিম আফ্রিকার বিশাল এলাকার ফসল ধ্বংস হয়েছে।
সম্মেলনের শুরুতে মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামেহ শুকরি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা’ সম্পর্কে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এখনই সচেতন না হলে সামনে কঠিন সময় আসছে। ধনী দেশগুলো জলবায়ু তহবিলে যে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তার দ্রুত বাস্তবায়নের ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি আরো জানান, কেবল জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণেই আফ্রিকার দেশগুলোর মাথাপিছু আয় ১৫ শতাংশ কমে গেছে। আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের তথ্যমতে, পুনর্গঠন কাজে যে অর্থায়ন দরকার আফ্রিকার অধিকাংশ দেশের পক্ষে তা নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। কারণ একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দেশগুলোতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘন ঘন হানা দিচ্ছে। অপরদিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিসর সীমিত হয়ে যাওয়ার দেশগুলোর ক্রেডিট রেটিং নিম্নগামী। ক্রেডিট রেটিং একটি দেশের বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার যোগ্যতার সূচক। সব মিলিয়ে দেশগুলো দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে পড়ে গেছে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য আফ্রিকার দেশগুলোর অবদান ৪ শতাংশের কম হলেও মহাদেশটিকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয় মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ভয়াবহ বন্যায় এবার পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের শত শত একর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নাইজেরিয়া। বন্যায় দেশটির আবাদি জমির প্রায় পুরোটাই তলিয়ে। পশ্চিম আফ্রিকা যখন ডুবছে বন্যায়, পূর্ব আফ্রিকায় তখন চলছে খরা। খরায় প্রায় ৫ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে কেবল সোমালিয়াতেই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ১ কোটির মতো। পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলোতে গত ৪০ বছর এত ভয়াবহ খরা আর হয়নি।
অন্যদিকে মরক্কো থেকে তিউনিসিয়া পর্যন্ত উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো পুড়ছে গরমে। তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিসে জুলাই মাসে রেকর্ড তাপমাত্রা ওঠে ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। কয়েক দশকের মধ্যে সেখানে এত গরম আর পড়ে নাই। দক্ষিণাঞ্চলীয় মাদাগাস্কার, মালাবি ও মোজাম্বিক বছরের শুরুর দিকে ঘূর্ণীঝড়ে লন্ডভন্ড হয়।
আফ্রিকার দেশগুলোর নাজুক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে মিশর ও আরো কয়েকটি দেশ এবার জলবায়ু তহবিলে ধনী দেশগুলোর প্রতিশ্রুত অর্থ প্রদানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। ধনী দেশগুলো ২০১০ সালে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ২০২০ সাল পর্যন্ত তারা ঐ তহবিলে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার দিয়ে যাবে। কিন্তু সেটি তারা করেনি। আফ্রিকান ইউনিয়ন কমিশনের প্রধান মুসা ফাকি মাহামাত সেপ্টেম্বরে আফ্রিকা অ্যাডাপশন সামিটে অভিযোগ করেন, ধনী দেশগুলো তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি তো রাখছেই না উলটো তাদের ওপর জলবায়ু খাতে জিডিপির ২ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিলের জন্য বরাদ্দ ৫.৭ বিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ১১.৪ বিলিয়ন পর্যন্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর এই অর্থ দেওয়ার অঙ্গীকার তিনি করলেও কংগ্রেস এ পর্যন্ত মাত্র বার্ষিক ১ বিলিয়ন ডলার অনুমোদন করেছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, যেহেতু প্রতিশ্রুতিটির মোট পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার। তাই যুক্তরাষ্ট্র এর ১০০ ভাগের একভাগ বহন করতে দায়বদ্ধ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চীন, ভারত ও ব্রাজিলের মতো বৃহত্ কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলোকেও এক্ষেত্রে এগিয়ে আসা উচিত। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেস সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে (বিশ্বের ধনী ও দরিদ্র অংশ) আস্থা কমে যাচ্ছে।
ইউরোপের দেশগুলোর প্রতি আফ্রিকানদের অভিযোগ রয়েছে যে, তারা আফ্রিকাকে নিজস্ব জ্বালানি উেসর মতো ব্যবহার করেছে। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ করে আফ্রিকার প্রতি তাদের মনোযোগ পড়েছে। জার্মানি এখন সেনেগালে একটি নবায়নযোগ্য জ্বালানি ভিত্তিক বিদ্যুত্ উত্পাদনকেন্দ্র নির্মাণের কথা ভাবছে। জলবায়ু গবেষণা সংস্থা পাওয়ার শিফট আফ্রিকার পরিচালক মোহামেদ আদাও সম্মেলনে উপস্থিত জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘আমাদের কথা পরিষ্কার, ঔপনিবেশিক যুগ অতীতের বিষয়। আমরা জ্বালানি ঔপনিবেশিকতা মেনে নেব না।’ এ বছর জলবায়ু সম্মেলন এমন এক মহাদেশে হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের ফল যেখানে সহজেই দৃশ্যমান।