দেশে প্রতি হাজারে ৩৬১ জন শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে পাঁচ বছরের নিচে মারা যাওয়া শিশুর প্রতি পাঁচ জনে এক জন নিউমোনিয়া বা ফুসফুসের সংক্রমণে মারা যায়। যা শতকরা হিসাবে ১৮ জন। এছাড়া জন্মের পাঁচ বছর শেষ হওয়ার আগেই প্রতি হাজারে আট জন শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। এই প্রতিরোধযোগ্য রোগটিতে বছরে ২৪ হাজার ৮২০ শিশু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। সেই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ৬৮ জন শিশু মারা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
এমন প্রেক্ষাপটে নিউমোনিয়া সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আজ ১২ নভেম্বর পালিত হচ্ছে বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস-২০২২। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে—‘নিউমোনিয়া এফেক্টস এভরিওয়ান’ অর্থাৎ ‘নিউমোনিয়া সবাইকে আক্রান্ত করে।’ দিবসটি উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালের রেসপিরেটরি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল ও লাং ফাউন্ডেশন সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এ দিন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে চিকিৎসক, নার্স ও রোগীদের নিয়ে র্যালি, আলোচনাসভা ও সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করা হবে। সম্প্রতি ঢাকা শিশু হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, শীতের শুরুতে ঠাণ্ডাজনিত রোগসহ নিউমোনিয়ার প্রকোপ বাড়ছে। বিশেষ করে হাসপাতালগুলোতে তীব্র নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশু রোগীর ভিড় দেখা যায়। ভর্তি থাকা ১১ মাস বয়সী লাবিব। শিশুটির মা লায়রা বলেন, শীতের শুরুতেই গ্রামে বেশি ঠাণ্ডা পড়ছে। বাচ্চাকে যত্নে রাখলেও ১০দিন আগে ঠাণ্ডা-কাশি জ্বর শুরু হয়। শ্বাসকষ্ট হওয়ায় স্থানীয় চিকিৎসকর পরামর্শে গত সাত দিনে আগে ভর্তি হই। এখন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
শিশু হাসপাতালের রেসিডেন্ট চিকিৎসক ডা. মুনতা তাবাসসুম বলেন, দেশে নিউমোনিয়া রোগী বেশি। শিশুদের মধ্যে রোগটি আরও বেশি। এবার শীত শুরুর আগেই রোগীর চাপ বাড়ছে। এখানে প্রতিদিন যত রোগী ভর্তি হচ্ছে তার প্রায় পঞ্চাশ শতাংশই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। তবে ঢাকার বাইরে থেকে রোগী বেশি আসছে।
শিশু হাসপাতালের এপিডিওমোলজিস্ট মাহফুজুর রহমান মামুন বলেন, গত বছর ২ হাজার ২২৭ জন শিশু নিউমোনিয়া নিয়ে ভর্তি হলেও এবার বুধবার পর্যন্ত ২ হাজার ৪৩৪ ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত বছরের অক্টোবরে ২৩৩ জন ভর্তি ছিল। এ বছরের অক্টোবরে ৩০৮ জন ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন। চলতি নভেম্বরের প্রথম ৯ দিনে ৮৪ জন শিশু নিউনোমোনিয়া নিয়ে ভর্তি হয়েছে।
আইসিডিডিআর,বির সহযোগী বিজ্ঞানী ডা. আহমেদ এহসানুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, হাইপক্সেমিয়ায় (রক্তে অক্সিজেনের স্বল্পতা) আক্রান্ত যে কোনো রোগীর জন্য চিকিৎসা হিসাবে অক্সিজেন থেরাপি প্রয়োজন। তিনি বলেন, সারা বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৭ কোটি ৩০ লাখ মানুষ নিউমোনিয়াজনিত সমস্যা হাইপোক্সিমিয়ায় আক্রান্ত হয়। যার মধ্যে ৩ কোটি ২ লাখই শিশু। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের অবকাঠামো অনুযায়ী, মাধ্যমিক স্তরের স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রে নিউমোনিয়া সমস্যা নিয়ে আসা শিশুর প্রায় ৪২ শতাংশই হাইপোক্সিমিয়ায় ভোগে। তাই জেলা, উপজেলা হাসপাতালে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ব্যবস্থা করলে নিউমোনিয়ায় শিশুমৃত্যু কমবে।
আহমেদ এহসানুর রহমান বলেন, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর শিশুরা হাইপোক্সেমিয়ায় (রক্তে অক্সিজেনের স্বল্পতা) বেশি মারা যায়। কোভিডের সময় এটা আরও বেশি হয়। যেসব শিশুর অক্সিজেনের স্বল্পতা থাকে, তাদের নিউমোনিয়ায় মৃত্যুহার বেশি। তাই প্রতিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পালস অক্সিমিটার থাকা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মাত্র পাঁচ ভাগ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিউমোনিয়ার পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা সক্ষমতা আছে। ৫০ ভাগ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অক্সিজেন কনসেনট্রেটর নেই। এক-তৃতীয়াংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অক্সিজেনের অন্যান্য সোর্স অনুপস্থিত। পালস অক্সিমিটার রয়েছে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ জেলা হাসপাতালে।