সরকারের বিভিন্ন বিচ্যুতি-অসংগতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে সমালোচনা করে আসা জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের হঠাৎ করেই আটকে গেছেন আইনি জালে। দল থেকে বহিষ্কৃত সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধার একটি মামলায় গত ৩১ অক্টোবর জি এম কাদেরের ওপর দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেন ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ মাসুদুল হক। শুধু সিদ্ধান্ত গ্রহণেই নয়, চেয়ারম্যান হিসেবে দলীয় কার্যক্রম থেকেই বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গতকাল সকালে ঢাকার প্রথম যুগ্ম-জেলা জজ মাসুদুল হকের আদালতে জি এম কাদেরের আবেদনের ওপর শুনানি হয়। জি এম কাদেরের পক্ষে শুনানি করেন তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট শেখ সিরাজুল ইসলাম। শুনানি শেষে প্রথমে আদালত জানিয়েছিল—সন্ধ্যায় আদেশ দেওয়া হবে। সন্ধ্যায় জানানো হয়, ১৬ নভেম্বর আদেশ দেওয়া হবে। এর ফলে, চেয়ারম্যান হিসেবে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারা না পারার বিষয়ে জানতে আরও পাঁচ দিন ঝুলে থাকতে হচ্ছে জি এম কাদেরকে। আদেশের দিন নির্ধারিত হওয়ার পর সন্ধ্যায় জি এম কাদেরকে এই প্রতিবেদক ফোন করলে তিনি হাসেন। পরে শুধু বললেন, ‘আমার জন্য দোয়া করো।’
আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে গত ১০ দিন ধরে চুপচাপ রয়েছেন জি এম কাদের। কোথাও কোনো বক্তব্য রাখছেন না। দলীয় কার্যক্রমেও অংশ নিচ্ছেন না। বনানী কার্যালয়ে মাঝেমধ্যে গেলেও দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন না। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে কেবল গত রবিবার সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে ২০তম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্য দিয়েছেন। বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের অনুপস্থিতিতে বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে তিনি ঐদিন সংসদে বক্তব্য রাখেন।
১০ নভেম্বরকে সাধারণত ‘নূর হোসেন দিবস’ হিসেবে পালন করা হলেও জাপা প্রতিবছর দিনটিকে পালন করে ‘গণতন্ত্র দিবস’ হিসেবে। দিবসটি উপলক্ষে গতকাল বিকালে রাজধানীর কাকরাইলে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাপা আয়োজিত আলোচনা সভায়ও যাননি জি এম কাদের। দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ অন্যরা এতে বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে জাপা মহাসচিব চুন্নু বলেছেন, ‘রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে আদালতের আদেশ দেওয়া পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। জাপার অগ্রযাত্রাকে কেউ থামিয়ে রাখতে পারে না। এর আগে, গত ৫ নভেম্বর জাতীয় সাংস্কৃতিক পার্টির কেন্দ্রীয় সম্মেলনেও যাননি জি এম কাদের। তার পরিবর্তে সেদিন প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ।
দলের সাবেক এমপি জিয়াউল হক মৃধাকে গত ১৭ সেপ্টেম্বর দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এরপর মৃধা গত ৪ অক্টোবর জিএম কাদেরকে জাপার চেয়ারম্যান হিসেবে অবৈধ ঘোষণার ডিক্রি চেয়ে ঢাকার প্রথম যুগ্ম-জেলা জজ আদালতে মামলা করেন। একই মামলায় দল থেকে মৃধার বহিষ্কারাদেশকে বেআইনি ঘোষণা এবং দলীয় গঠনতন্ত্রের ২০এর উপধারা ১(১) অবৈধ ঘোষণা চাওয়া হয়েছে। মামলায় জি এম কাদের ছাড়াও নির্বাচন কমিশনের সচিব, জাপার মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুগ্ম-দপ্তর সম্পাদককে বিবাদী করা হয়। বহিষ্কারের আগ পর্যন্ত মৃধা জাপা চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। মৃধার মামলায় আদালত গত ৩১ অক্টোবর জি এম কাদেরের ওপর দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেন। এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চেয়ে মঙ্গলবার একই আদালতে আবেদন করেন জি এম কাদের।
জি এম কাদেরের আইনজীবী শেখ সিরাজুল ইসলাম গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমরা আমাদের দরখাস্তে বলেছি, মামলাটি চলার কথা নয়। কারণ বাদী (মৃধা) তার আবেদনে নিজেকে ‘জাপার উপদেষ্টা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু দলীয় গঠনতন্ত্রে ‘জাপার উপদেষ্টা’ বলে কোনো পদ নেই। জাপা চেয়ারম্যানের একটি উপদেষ্টা পরিষদ রয়েছে। চেয়ারম্যান তাকে (মৃধাকে) গঠনতন্ত্র মোতাবেক পার্টি থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে বাদীর আবেদন অসত্য, অমূলক। এখানে মামলা দায়েরের কোনো আইনি ভিত্তিই নেই। কারণ, রাষ্ট্র চলে সংবিধান ও আইন অনুযায়ী; আর রাজনৈতিক দল চলে নিজেদের গঠনতন্ত্র মোতাবেক। এছাড়া বাদী তার আবেদনে বলেছেন, জি এম কাদেরের বিষয়ে হাইকোর্টে রিট বিচারাধীন। কিন্তু হাইকোর্ট শুধু রুল দিয়েছে। ঐ রুলের পর দলের কাউন্সিল হয়েছে, পার্টি চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদের সংসদের একাধিক উপনির্বাচনে দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন ও প্রতীক দিয়েছেন। তিনি নিজেও সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কাউন্সিলের মাধ্যমেই তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত। কাজেই, এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।’
অন্য দিকে একই আদালতে দায়ের করা পৃথক আরেকটি মামলায় মঙ্গলবার জি এম কাদেরকে কারণ দর্শাতে বলেছেন যুগ্ম জেলা জজ মাসুদুল হক। এ মামলাতেও দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জি এম কাদেরের ওপর কেন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে না, সে ব্যাপারে তাকে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে। জানা গেছে, এই মামলায় আপত্তি দাখিল করার জন্য সময় চেয়ে আবেদন করেছেন জি এম কাদের। আগামী ২ জানুয়ারি মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। পৃথক এই মামলাটি করেছেন জাপা থেকে বহিষ্কৃত মসিউর রহমান রাঙ্গা। গত ২৩ অক্টোবর তিনি মামলাটি করেন।
মামলায় জিয়াউল হক মৃধা ও মসিউর রহমান রাঙ্গা দুজনেই দাবি করেন, ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই জাপার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের মৃত্যুর ছয় মাস আগে ১ জানুয়ারি জি এম কাদের তার বড় ভাই এরশাদকে ভুল বুঝিয়ে ‘জাতীয় পার্টির জন্য ভবিষ্যৎ নির্দেশনা’ শিরোনামে একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করান। এরপর জি এম কাদের প্রথমে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, পরে চেয়ারম্যান হন, যা ছিল গঠনতন্ত্রের পরিপন্থী। এ নিয়ে দলের ভেতরে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে এরশাদ ২০১৯ সালের ২২ মার্চ জি এম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে অব্যাহতি দেন। ৪ মে পুনরায় তাকে জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেন। তখন এরশাদ গুরুতর অসুস্থ থাকায় তিনি স্বাভাবিক বিবেচনা প্রয়োগে সক্ষম ছিলেন না বলে মামলায় দাবি করা হয়েছে। এরশাদের মৃত্যুর পর ২০১৯ সালের ১৮ জুলাই সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা দেন জি এম কাদের। দলের গঠনতন্ত্রে এভাবে চেয়ারম্যান ঘোষণার কোনো বিধান নেই বলেও মামলায় উল্লেখ করা হয়।
মামলায় রাঙ্গা দাবি করেন, জি এম কাদের নিজেকে জাপার চেয়ারম্যান দাবি করে ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সম্মেলন ডাকেন। এর আগে এ সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে ১৯ ডিসেম্বর হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন হয়। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান ঘোষণা কেন বেআইনি হবে না, মর্মে রুল দেয় হাইকোর্ট। এটি বিচারাধীন অবস্থায় দলের কাউন্সিল করেন জি এম কাদের। রাঙ্গার মামলার বিষয়ে অ্যাডভোকেট শেখ সিরাজুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, ‘হাইকোর্ট তো কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি, রুল দিয়েছে। সেজন্য কাউন্সিল অনুষ্ঠানে কোনো আইনি বাধা ছিল না। তাছাড়া যখন কাউন্সিল হয়, তখন রাঙ্গা ছিলেন পার্টির মহাসচিব। এমনকি, কাউন্সিলের মাধ্যমে জি এম কাদের চেয়ারম্যান এবং রাঙ্গা মহাসচিব নির্বাচিত হন। তাহলে রাঙ্গা এখন এই প্রশ্ন তুলছেন কীভাবে।’
এদিকে কাজী নাফিজ মাহফুজ নামে জাপা থেকে বহিষ্কৃত আরেক নেতা গত সোমবার ঢাকার দ্বিতীয় সহকারী জজ আদালতে জি এম কাদেরকে জাপার চেয়ারম্যান হিসেবে অবৈধ ঘোষণার ডিক্রি চেয়ে আবেদন করেন। আদালত আবেদনটি বুধবার খারিজ করে দিয়েছে।