আমদানি কমেছে খাদ্যশস্যের। বিশেষত প্রধান দুই খাদ্যশস্য চাল ও গমের। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় আমদানি কমেছে ৭ লাখ ৯৩ হাজার টন বা ৩৮ দশমিক ১২ শতাংশ। কয়েক দফায় বেসরকারিভাবে চাল আমদানির সময় বাড়িয়েও আমদানি বাড়ানো যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ডলার সংকটে ব্যাংকে চাহিদানুযায়ী ঋণপত্র খুলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। এছাড়া বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যশস্য আমদানির উৎস দেশ সীমিত হয়ে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে আমদানিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আমদানি কমে যাওয়া খাদ্যনিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের। এই উদ্বেগ কাটাতে সরকারকে আমদানি করে খাদ্যশস্যের মজুত বাড়াতে হবে। এদিকে খাদ্যশস্য আমদানি কমার পাশাপাশি চলতি অর্থবছর কমতে পারে, খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণও। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ এরই মধ্যে দেশে চাল উৎপাদন কমার আভাস দিয়েছে। গত অক্টোবরে প্রকাশিত সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছর দেশে ৩ কোটি ৫৬ লাখ টন চাল উৎপাদন হতে পারে। যা গত অর্থবছরের চেয়ে ২ লাখ টন কম।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) চাল ও গম আমদানি হয়েছে ১২ লাখ ৮৭ হাজার টন। গত অর্থবছরে একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ২০ লাখ ৮০ হাজার টন। এক বছরের ব্যবধানে আমদানি কমেছে ৭ লাখ ৯৩ হাজার টন বা ৩৮ দশমিক ১২ শতাংশ। জাতিসংঘ এরই মধ্যে আগামী বছর বৈশ্বিক খাদ্যসংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। দেশেও সংকট মোকাবিলায় খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
সময় বাড়িয়েও চাল আমদানি বাড়ছে না: বেসরকারিভাবে চাল আমদানির সময়সীমা কয়েক দফা বাড়িয়েও চাল আমদানি বাড়ছে না। চাল আমদানির জন্য বরাদ্দ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো আগামী ২০ নভেম্বর পর্যন্ত এলসি খোলার সময় দেওয়া হয়েছে বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। চাল আমদানির স্বার্থে এ সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে বলে সম্প্রতি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (বৈদেশিক সংগ্রহ) মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, অনুমতি পাওয়া আমদানিকারকদের অবশ্যই আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সমুদয় চাল আমদানি করে তা বাজারজাত করতে হবে। উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি সরকারিভাবে ১৪ লাখ ৩০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে ৫ লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি হয়েছে। আর বেসরকারি খাতে ১৫ লাখ টন চাল আমদানির বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সরকারি-বেসরকারি খাতে ৩ লাখ ৩ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে।
আমদানি কমেছে গমের: চালের পাশাপাশি আমদানি কমেছে আরেক প্রধান খাদ্যশস্য গমের। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে দেশে গম আমদানি হয়েছে ৯ লাখ ৮৪ হাজার টন। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে গম আমদানি হয়েছিল ১৫ লাখ ৩০ হাজার টন। এ হিসেবে মাত্র চার মাসে গম আমদানি কমেছে ৫ লাখ ৪৬ হাজার টন বা ৩৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
কি পরিমাণ মজুত আছে খাদ্যশস্যের? খাদ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য বলছে, বর্তমানে সরকারের গুদামে ১৫ লাখ ৭৩ হাজার ৪৮৫ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুত আছে। এরমধ্যে চাল ১৩ লাখ ৫৮ হাজার ৭৫ মেট্রিক টন ও গম ২ লাখ ৫ হাজার ৬৭৪ টন। এছাড়া চলতি আমন মৌসুমে ৮ লাখ টন ধান-চাল কেনার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এই পরিমাণ খাদ্যশস্যের মজুত কি খাদ্যনিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট? এ প্রশ্নে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, আমদানি কমে যাওয়া খাদ্য নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের। এই উদ্বেগ কাটাতে সরকারকে খাদ্য আমদানিতে জোর দিতে হবে। তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে চাল সংগ্রহ করে তা যদি আবার ওএমএসে দেওয়া হয় তাহলে কোনো লাভ হবে না। কারণ, এতে বাজারে চালের সরবরাহ বাড়ল না। সরবরাহ বাড়াতে সরকারের উচিত হবে, আমদানি করে ওএমএসে চাল দেওয়া। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওএমএসসহ সরকারের বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালানোর পরও খাদ্য নিরাপত্তায় সবসময় সরকারের গুদামে কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ লাখ টন খাদ্যশস্য থাকা উচিত।
জনসংখ্যার অনুপাতে দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়েনি: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সূত্র বলছে, গত পাঁচ বছরে যে হারে জনসংখ্যা বেড়েছে। তার চেয়ে কম হারে বেড়েছে খাদ্যশস্য উৎপাদন। ওয়ার্ল্ডোমিটারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৫ কোটি ৯৭ লাখ। যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৮১ লাখের কিছু বেশি। অর্থাৎ পাঁচ বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ।
অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সূত্র জানিয়েছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চাল ও গমের মোট উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ৭৩ লাখ টন। এর পরের অর্থবছরে উৎপাদন কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ কোটি ৭৪ লাখ ৮ হাজার টনে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ কোটি ৭৬ লাখ ৩৪ হাজার টন ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩ কোটি ৮৬ লাখ ৯৪ হাজার টন চাল ও গম উৎপাদন হয়। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে চাল ও গমের উৎপাদন কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৩০ হাজার টন। খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়েছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ হারে। এ হিসেবে যে হারে জনসংখ্যা বেড়েছে সে হারে খাদ্য উৎপাদন বাড়েনি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক আগামী তিন বছরের মধ্যে চালের উৎপাদন ৩২ লাখ টন বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। খাদ্যশস্য আমদানি কম হলেও দেশে খাদ্য সংকটের কোনো আশঙ্কা আছে কি না? এ প্রশ্নে গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির বৈঠক শেষে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেন, দেশে খাদ্য ঘাটতির কোনো আশঙ্কা নেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চাল-গমের আমদানি কম হলেও আমাদের বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল আছে।