বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাত্র আড়াই মাসের মাথায় ৩ নভেম্বর কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। দেশের ইতিহাসের অন্যতম বর্বরোচিত কলঙ্কময় এ দিনটিতে চার নেতার আত্মত্যাগকে যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যমে স্মরণ করছে জাতি। এই শোকাবহ দিনে নিজের জন্মবার্ষিকী পালন না করে হৃদরোগে (হার্ট ফুটো) আক্রান্ত এক স্কুলপড়ুয়া ছাত্রের পাশে দাঁড়িয়েছে শিশু জান্নাতুল মাওয়া। নিজে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে অসুস্থ জিসান মাহমুদের চিকিৎসার জন্য সমাজের বৃত্তবানদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে
বৃহস্পতিবার (৩ নভেম্বর) সকালে রংপুর নগরীর ৭নং ওয়ার্ডের বেনুঘাট চওড়ারহাট এলাকার জিসান মাহমুদের হাতে সহায়তার অর্থ তুলে দেন শিশু জান্নাতুল মাওয়া ও তার মা মনিরা আক্তার। এসময় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘স্প্রেড স্মাইলস’ এর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
অসুস্থ জিসান মাহমুদ নগরীর গুলালবুদাই উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। তার বাবা জাহিদুল ইসলাম কৃষি কাজ করেন। জন্মগতভাবে হার্ট ফুটো জিসানের। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে তার চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেকটাই নিঃস্ব হয়ে গেছেন অসহায় মা-বাবা। স্থানীয় এলাকাবাসীর সহযোগিতা ও চিকিৎসকের পরামর্শে এবার সন্তানকে ভারতে নিয়ে চিকিৎসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন জাহিদুল। কিন্তু অর্থ সংকটে সন্তানের সুচিকিৎসা নিয়ে চিন্তিত তিনি।
এ পরিস্থিতিতে ছোট্ট শিশু জান্নাতুল মাওয়া আর্থিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসাতে আবেগআপ্লুত হয়ে উঠেন জিসান মাহমুদের বাবা। তিনি তার সন্তানের চিকিৎসার জন্য সবার কাছে দোয়া ও সহায়তা চেয়েছেন।
এদিকে নিজের জন্মের ছয় বছর পূর্তিতে শুধু জিসানের হাতে আর্থিক সহায়তা তুলে দিয়েই থেমে থাকেনি জান্নাতুল মাওয়া। মায়ের সঙ্গে ছুটে যান বকসা বৃদ্ধাশ্রমেও। অসহায়, বঞ্চিত, আশ্রয়হীন ও নিপীড়িত মানুষের জন্য গড়ে তোলা ওই বৃদ্ধাশ্রমে সবার সঙ্গে কথা বলে হাতে হাতে ফুল তুলে দেন। এসময় আলোকিত মানুষ হবার স্বপ্ন দেখা শিশু জান্নাতুল মাওয়া সবার কাছে দোয়াও চান।
জান্নাতুল মাওয়া এই প্রতিবেদককে বলেন, আজ আমার জন্মদিন। পাশাপাশি ১৫ আগস্টের মতো একটি কলঙ্কিত দিন আজ। আজকের এদিনে জাতীয় চার নেতাকে কারাগারে হত্যা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ছিলেন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, তাজউদ্দিন আহমেদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম। আজকের দিনটি বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত দিন, এজন্য আমি এদিনে কোনো আনন্দ পছন্দ করি না।
মাওয়া আরও বলেন, ছোট মামা আমার জন্মদিনে ছোট্ট একটি কেককাটার আয়োজন করে। যেন আমি ভাই-বোনদের সঙ্গে একটু মজা করতে পারি। তবে মা এদিনে মসজিদে মিলাদ ও দোয়ার আয়োজন করে থাকেন। আর আমি সুবিধা বঞ্চিত পথশিশুদের সঙ্গে কাটাই, এতিমখানাতে যাই। কিন্তু এবারের জন্মদিনে আমি জানতে পারি এক ভাইয়ার হার্ট ফুটো, সে ভীষণ অসুস্থ। এজন্য আমি তার চিকিৎসায় সহায়তা নিয়ে পাশে থাকার ইচ্ছে জানালে মাও আমার কথায় রাজি হন। মা এবং মামাকে সঙ্গে নিয়ে আমি ওই ভাইয়ার বাড়িতে গিয়ে সহায়তার অর্থ তুলে দিয়েছি। আমি চাই যদি জিসান ভাইয়ার চিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসুক, তাহলে তাকে উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা সম্ভব।
ক্ষুদে জান্নাতুল মাওয়ার এমন উদ্যোগে বিস্মিত বেনুঘাট চওড়ারহাট গ্রামের লোকজন। জান্নাতুল মাওয়ার জন্ম ২০১৬ সালের ৩ নভেম্বর। রংপুর নগরীর কটকিপাড়ায় তাদের বসবাস। রংপুরের দ্য মিলিনিয়াম স্টারস স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে জান্নাতুল মাওয়া। তার মা মনিরা আকতার রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক।
বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বুকে ধারণ করে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক হয়ে বেড়ে উঠবে জান্নাতুল মাওয়া- এমনটাই প্রত্যাশা তার স্বপ্ন পূরণের সারথী মা মনিরা আকতার। তিনি বলেন, গত জন্মদিনটাও কাটিয়েছে পথশিশুদের নিয়ে। কেক কাটার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল অর্ধশত পথশিশু। ওর মধ্যে সবসময় ব্যতিক্রম কিছু করার চিন্তা কাজ করে।
তিনি বলেন, কথা বলতে শেখার পর থেকেই মাওয়ার স্মৃতিশক্তির প্রখরতা বুঝতে পারি। প্রথমে তাকে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে কিছু শেখাই। আরবিতেও তার দক্ষতা ফুটে উঠছে। পবিত্র কোরআন শরিফের ছোট ১০টি সুরাসহ আয়াতুল কুরসি মুখস্থ তার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণও না দেখে বলতে পারে। এছাড়া ছবি আঁকায়ও বেশ পারদর্শী সে। দেশবরেণ্য কবি-সাহিত্যিকদের দেড় শতাধিক কবিতা, ছড়া তার মুখস্থ। কারাত প্রশিক্ষণে বেশ ভালো করছে মাওয়া।
মনিরা আকতার বলেন, আমি বিশ্বাস করি, আমার মেয়ে যে সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ভালোবেসে বাংলার ইতিহাস লালন করে এগিয়ে যাচ্ছে একদিন সে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক হয়ে উঠবে এবং দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করবে।