বিএনপির সংসদ সদস্যরা (এমপি) যেকোনো সময় সংসদ থেকে পদত্যাগ করবেন বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেছেন, আমাদের সোজা কথা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া এই দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। এটা আমাদের সাফ কথা। আমাদের দলের সংসদ সদস্যরাও যেকোনো সময় সংসদ থেকে পদত্যাগ করবেন। এই সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। নতুন একটা নির্বাচন কমিশন গঠন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন হবে। দেশের মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে।
শনিবার (২৯ অক্টোবর) বিকেলে রংপুরের ঐতিহাসিক কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠে আয়োজিত বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব এসব কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বক্তব্যের শুরুতে আঞ্চলিক ভাষায় দলের উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, কেমন আছেন বাহে? ভালো আছেন তো? আমরা রংপুর ডিভিশনের ছাওয়া। আমরা ভালো থাকিমো। অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়নকে জয় করে আমরা বাহের দেশের মানুষ ভালো থাকমো ইনশাআল্লাহ।
তিনি বলেন, আজকের এই সমাবেশের দিকে সমগ্র বাংলাদেশ তাকিয়ে আছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, এই সমাবেশের দিকে সারা বিশ্বের অনেকগুলো আন্তর্জাতিক মিডিয়ার নজর রয়েছে। এখানে আলজাজিরা, বিবিসির সাংবাদিকরা উপস্থিত রয়েছেন। আপনারা (দলের নেতাকর্মীরা) তিন দিন ধরে অমানবিক পরিশ্রম করেছেন, অমানবিক অবস্থায় থেকেছেন। গুদাম ঘরে, রাস্তাঘাট-ফুটপাতে থেকেছেন। কেউ নৌকায় করে এসেছেন,কেউ সাইকেল চালিয়ে এসেছেন। আমি আপনাদের কষ্ট দেখেছি।
তিনি বলেন, সরকার নাকি বিরোধী দলকে ভয় পায় না। সরকার নাকি জনগণকে ভয় পায় না। ভয় যদি না পায় তাহলে দুই দিন আগে গাড়ি বন্ধ করে দিলো কেন? খুলনাতে গাড়ি বন্ধ করে, ট্রলার উল্টে দিয়ে মানুষকে চাপাতি-রামদা দিয়ে মেরেছে কেন? কেন আমাদের নেতাদের গুলি করে মারো?
মির্জা ফখরুল বলেন, এই সমাবেশ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সমাবেশ। একটা মানুষ, একটা দল গত ১৫ বছর ধরে আমাদের দমন-পীড়ন করছে। সমস্ত দেশটাকে তারা কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে। দেশের অর্থনীতিকে চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়েছে। এখন বাংলাদেশকে খাওয়ার পাঁয়তারা করছে।
তিনি বলেন, এই সমাবেশের লক্ষ্য একটাই, হাসিনা কবে যাবে? এই সরকার কবে যাবে? দাবি একটাই, এই সরকারের পদত্যাগ। গত ১৫ বছরে এই আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের যত অর্জন ছিল, যত স্বপ্ন ছিল সমস্ত কিছুকে ধ্বংস করে দিয়েছে, নষ্ট করে দিয়েছে। যেদিকে তাকাবেন খালি চুরি চুরি আর চুরি।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, এখন বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতাসহ সব ভাতাতে ভাগ নেয় আওয়ামী লীগ। রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্ট তৈরি করতেও তারা এখন টাকা চুরি করে। এমনকি গরিবের আশ্রয়ণ প্রকল্পেও চুরি করছে। তারা সর্বক্ষেত্রে লুট করছে। সব খেয়ে ফেলছে। আর কিছু বাকি রাখেনি। সরকার এখন ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসি’র মতো সব খেয়ে ফেলছে।
তিনি আরও বলেন, এই সরকার আমাদের নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দিচ্ছে না। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করেছে। তিনি অসুস্থ হওয়ার কারণে বিদেশে চিকিৎসার জন্য গেছেন। এখন তাকে আর দেশে ফিরতে দেওয়া হচ্ছে না। তার বিরুদ্ধে অসংখ্য মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা করা হয়েছে। আমাদের ৬০০ নেতাকর্মীকে গুম করেছে এই সরকার। সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করেছে। আলেম-ওলামাদেরও মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করেছে। এদের কি আর ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া যায়?
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, যারা দেশকে ধ্বংস করছে, মানুষকে ধ্বংস করছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করছে তাদেরকে আর ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া যাবে না। আজ দেশ একটা কঠিন দুঃসময় পার করছে। আমরা কোথায় যাব? এখন জোর করে ক্ষমতায় থাকা অবৈধ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বলছেন- দেশে নাকি দুর্ভিক্ষ হবে। দুর্ভিক্ষ হলে মানুষ কোথায় যাবে? যদি দেশে দুর্ভিক্ষ হয় তার জন্য সমস্ত দায় দায়িত্ব নিতে হবে শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলেও দেশে একটা দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। রংপুর স্টেশনে মানুষ না খেয়ে পড়ে থাকত। খাবার না পেয়ে মারা যেত। কুড়িগ্রামের চিলমারীর বাসন্তী তার লজ্জা নিবারণের জন্য এক টুকরো কাপড় পায়নি। আবার সেই অবস্থা ফিরে এসেছে। আওয়ামী লীগ এতদিন ধরে কী করল? বাংলাদেশ নাকি মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে গেছে; বড়লোক হয়ে গেছে; সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া কানাডা হয়ে গেছে বাংলাদেশ। তাহলে দেশের ৪২ ভাগ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে কেন?
তিনি বলেন, ১০ টাকা কেজির চাল খাওয়াতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ। এখন ৯০ টাকায় চাল খাওয়াচ্ছে। ডাল, ডিম, চিনিসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে। শাকসবজি কিনতে গিয়েও মানুষ বাজার থেকে ফিরে আসছেন। আগে যে মানুষ একটু ভালোমন্দ খেত, এখন সেটাও শেষ। মানুষ কী খেয়ে থাকবে?
সরকার প্রধানের ধৈর্য ধরার আহ্বান প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, দেশের জনগণকে ধৈর্য ধরতে বলছেন প্রধানমন্ত্রী; অল্প খেতে, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হতে বলছেন; দিনে বিদ্যুৎ থাকবে না, রাতে ফ্যান চালাবেন না। এসব আমাদের বলছে আর তারা খাচ্ছে চিতল মাছ। আমরা দেখছি আপনারা ঘন ঘন বিদেশ যাচ্ছেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে বিদ্যুৎ চালিয়ে আরাম-আয়েশ করছেন। আর দেশের মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। যারা কৃষি কাজ করছেন তারা সেচের পানি পাচ্ছেন না। এই হচ্ছে আওয়ামী লীগ।
জঙ্গিবাদ, অগ্নিসন্ত্রাসের ধুয়া তুলে সরকার আবার ষড়যন্ত্র করছে দাবি করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আওয়ামী লীগের জঙ্গিবাদ, অগ্নিসন্ত্রাসের অস্ত্র এখন ভোঁতা হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের আসল চেহারা সবাই জেনে গেছে। পৃথিবীর মানুষ জেনে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লিখেছে, আওয়ামী লীগ সরকার যা বলে সবই মিথ্যা কথা। এই সরকারের মানবাধিকারের রিপোর্ট মিথ্যা। দেশে মানুষের মানবাধিকার নেই। মানুষ গুম হয়ে যাচ্ছে। সরকার মানুষকে কথা বলতে দেয় না। নির্বাচনের আগে সভা করতে দেয় না। ভোট কেন্দ্রে যেতে দেয় না। আর কথায় কথায় রামদা, হকিস্টিক, বন্দুক পিস্তল নিয়ে আসে তারা। দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে আর এসব করতে দেবে না। দেশের মানুষ তাদের রুখে দেবে।
তিনি বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম একটা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য। এই হাসিনার বাংলাদেশ দেখার জন্য নয়। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য। মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি ভোট দিয়ে আমাদের পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচিত করার অধিকার পাবার জন্য। কিন্তু আমরা আজ সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত। এখন আগের রাতেই ভোট হয়ে যায়। আমরা আর এমন নির্বাচন হতে দেব না।
সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, রংপুরে গত দুদিন ধরে পরিবহন ধর্মঘট চলছে। তারপরও হাজার হাজার মানুষ ধর্মঘট উপেক্ষা করে রংপুরে এসেছেন। তারা পুরো রংপুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হরতাল তো দেয় বিরোধী দল। কিন্তু সরকার এখন হরতাল দিচ্ছে। তাহলে বুঝতে হবে দেশের অবস্থা কোথায়? আসল ব্যাপার হচ্ছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের নির্ভরশীলতা পেটুয়া বাহিনীর ওপর।
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, আজ রংপুর শহর মুখরিত। রংপুরের মানুষ প্রমাণ করেছে জনতা বিক্ষুব্ধ হলে কোনো শক্তি দমিয়ে রাখতে পারে না। তারা জানান দিচ্ছে আওয়ামী লীগের সময় শেষ।
ইকবাল হাসান মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যুদ্ধে জয়লাভ করলাম আমরা, ক্ষমতায় বসল আওয়ামী লীগ। দেশ তারা ফাঁকা করে দিয়েছিলেন। এরপর জিয়াউর রহমান দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন। বর্তমান দেশের ভিত জিয়াউর রহমান করে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ বাকশাল গঠন করে গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করেছিল। পরে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হারুনুর রশিদ বলেন, ধর্মঘট দিয়ে মানুষের আসা বন্ধ করতে পারেননি। জনসমাগম দেখে আপনাদের মনে কম্পন তৈরি হয়েছে। ১০ তারিখের ১০ দিন আগে ঢাকা যাওয়ার প্রস্তুতি নেব। ১০ তারিখে নতুন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আসব। মানুষ ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের খেলা দেখছে। সম্পদ লুট করে পাচার করছেন, ভোট চুরি করে ক্ষমতায় আছেন। গণতন্ত্রের মাকে বন্দী করে রেখেছেন। তারেককে মিথ্যা মামলা দিয়ে দেশের বাইরে রেখেছেন।
সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু বলেন, এবার খেলা হবে, তবে ওবায়দুল কাদেরের সাথে নয়। খেলা হবে শেখ হাসিনার সাথে তারেক রহমানের। ওবায়দুল কাদেরের সাথে খেলার জন্য আমাদের দলের মহিলা নেত্রীরাই যথেষ্ট।
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এ জেড এম জাহিদ হোসেন, রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সমাবেশের প্রধান সমন্বয়কারী আসাদুল হাবিব (দুলু), সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল খালেক, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি এস এম জিলানী, কৃষক দলের মহাসচিব শহিদুল ইসলাম (বাবুল), ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক সাইফ মোহাম্মদ জুয়েল, রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মাহফুজ উন নবী ডন, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম, সদস্য সচিব আনিছুর রহমান লাকু প্রমুখ।