দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় খুদে শিক্ষার্থীদের পুষ্টি নিশ্চিতে স্কুল ফিডিং কার্যক্রম চালু করে সরকার। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার কমানোসহ বেশ কিছু উদ্দেশ্য ছিল এ কার্যক্রমের। ২০১০ সালে চালু হওয়া এ প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে কয়েক দফা। সবশেষ গত জুন মাসের পর থেকে এ কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ। এতে সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিতি কমেছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত। দ্রুত স্কুল ফিডিং কার্যক্রম শুরু করা না হলে পুরো সময়ে শিক্ষার্থী ধরে রাখা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন শিক্ষকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ময়মনসিংহের পলাশতলী বৈল্লার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্কুল ফিডিং কার্যক্রম চালু অবস্থায় জুনে উপস্থিতি ছিল শতভাগ। সেপ্টেম্বরে এসে দাঁড়িয়েছে ৭৫ শতাংশে, পলাশতলী বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতভাগ থেকে সেপ্টেম্বরে নেমেছে ৯০ শতাংশে। জামালপুরের ছালিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৭৮ থেকে ৫৫ শতাংশ ও বজরা তবকপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮১ থেকে উপস্থিতি নেমেছে ৬৫ শতাংশে।
কুড়িগ্রামের মিয়াজীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জুনে স্কুল ফিডিং চলাকালীন উপস্থিতি ছিল ৭৮ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে নেমেছে ৬৩ শতাংশে। একই জেলার উত্তরপান্ডুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিন মাস আগের ৮১ শতাংশ থেকে উপস্থিতি নেমেছে ৭০ শতাংশে। এছাড়া দুর্গাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮৭ থেকে নেমেছে ৭৩ শতাংশে, বুড়াবুড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮৯ থেকে ৭৭ শতাংশে।
এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জাগো নিউজকে বলেন, স্কুল ফিডিং বন্ধ হওয়ার পর সব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিতি কমে গেছে। শিক্ষার্থীদের বাড়িতে গিয়ে অভিভাবককে বুঝিয়ে স্কুলে আনা হলেও দু-তিনদিন পর একই পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। কবে থেকে স্কুল ফিডিং চালু হবে তা অভিভাবক-শিক্ষার্থীরা জানতে চান। এ বিষয়ে আমরা কোনো তথ্য দিতে পারছি না। যেসব এনপিওকর্মী বিস্কুট দিতেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারাও কিছু বলতে পারছেন না।
এ বিষয়ে পশালতলী বৈল্লার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনিছুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, তিন মাস ধরে স্কুল ফিডিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় প্রতিদিন শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কমছে। সকালের শিফটে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা আর বিকেলের শিফটে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ক্লাস চলে। ক্লাসে কেউ কেউ বাসা থেকে খাবার নিয়ে এলেও অনেকে আনতে পারে না বলে তাদের না খেয়ে থাকতে হয়। সে কারণে ক্লাসে পড়ার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, গ্রামে দরিদ্রতার কারণে শিশুদের পুষ্টিহীনতা রয়েছে। স্কুল ফিডিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ক্ষুধা নিবারণ ও প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব মেটাতে উচ্চ পুষ্টিমানের বিস্কুট বিতরণ করা হতো। সেটি বন্ধ হওয়ায় অনেকের মধ্যে প্রাণোচ্ছ্বাস ও পড়ালেখায় উৎসাহ কমে যাচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় মনোযোগী করতে ও বিদ্যালয়ে উপস্থিতি বাড়াতে দ্রুত স্কুল ফিডিং কার্যক্রম চালুর দাবি জানান তিনি।
একই উপজেলার পলাশতলী বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্কুল ফিডিং বন্ধ থাকায় প্রায় ৩০ শতাংশ উপস্থিতি কমে গেছে বলে জানিয়েছেন প্রধান শিক্ষক মোছাম্মদ শামীমা নাসরিন। তিনি বলেন, বিস্কুট বিতরণ কার্যক্রম চালু থাকা অবস্থায় প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী ক্লাসে উপস্থিত হতো। বিরতির সময় তারা বিস্কুট আর পানি খেয়ে ভালোভাবে ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরতো। সেটি বন্ধ হওয়ায় অনেকে বিদ্যালয়ে আসতে চায় না। অনেক অভিভাবক জোর করে তার সন্তানকে ক্লাসে দিয়ে গেলেও পড়ালেখার প্রতি তার আগ্রহ থাকছে না।
এই প্রধান শিক্ষক আরও বলেন, কেন স্কুল ফিডিং বন্ধ করা হয়েছে তা অভিভাবক-শিক্ষার্থীরা জানতে চান। কবে থেকে আবার শুরু করা হবে সেটি বারবার প্রশ্ন করলেও আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। এমনিতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায় না। আমরা নানাভাবে বুঝিয়ে আমাদের এখানে ভর্তি করি। দীর্ঘ সময় ক্লাসে থাকতে হয় বলে বাচ্চাদের ক্ষুধা লেগে যায়। সে সময় কিছু না খেলে তাকে ক্লাসে মনোযোগী করা সম্ভব হয় না। স্কুল ফিডিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সেই চাহিদা মেটানো হতো।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেয়াদ শেষে তিন দফায় প্রায় দুই বছর প্রকল্পের সময় বাড়ালেও গত তিন মাস আগে সেটি শেষ হয়েছে। নতুন করে শুরু করতে এখন পর্যন্ত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি করা হয়নি। প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্ট্যাডির (সম্ভাব্যতা যাচাই) নামে তিন মাস পার হলেও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) এখনো সেটি শেষ করতে পারেনি। এরপর ফার্ম নির্বাচন, বাস্তবায়নকারী এনজিও ও খাদ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করতে হবে।
জানা যায়, শিক্ষার্থী ভর্তি, শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতির হার বাড়ানো, ঝরে পড়া রোধ ও প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নসহ বেশকিছু লক্ষ্য অর্জনে ২০১০ সালে দেশে দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়। এরপর দফায় দফায় সংশোধনী এনে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তৃতীয় দফায় প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ায় সরকার। মেয়াদ বৃদ্ধিতে দফায় শিশুদের খাবার দেওয়ার জন্য নতুন আরেকটি প্রকল্প প্রণয়নের শর্ত দেওয়া হলেও তৃতীয় দফার মেয়াদ গত মাসের ৩০ জুন শেষ হয়েছে। এখন পর্যন্ত ডিপিপি প্রণয়নের কাজ শুরু হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, স্কুল ফিডিং কার্যক্রম নতুনভাবে শুরু করতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠালে সেখান থেকে একটি ফিজিবিলিটি স্ট্যাডির (সম্ভাব্যতা যাচাই) জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বলা হয়। সেটি তৈরির পর নতুন করে ডিপিপি তৈরি করতে হবে। সেটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। যদি সেখানে কোনো অসঙ্গতি থাকে তবে পাঠানো হবে সংশোধনের জন্য। এরপর সেটি অনুমোদন দেওয়ার পর অফিস ও জনবল নিয়োগ করে এ কার্যক্রম শুরু করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিপিই’র মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত জাগো নিউজকে বলেন, স্কুল ফিডিংয়ের তৃতীয় ধাপের মেয়াদ গত ৩০ জুন শেষ হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে নতুন প্রকল্পের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাইমূলক প্রতিবেদন দিতে। এজন্য বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে কাজ শুরু করেছে। বর্তমানে ডাব্লিউএইচও এবং ডিপিই আলাদাভাবে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি শুরু করেছে।
তিনি বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাই কাজ শেষে নতুন করে ডিপিপি তৈরি করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। আশা করি আগামী অর্থবছর থেকে নতুন করে স্কুল ফিডিং কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, স্কুল ফিডিং থেকে তিন ধরনের লাভ হয়। করোনাপরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে পুষ্টিহীনতা দেখা দিয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিতরণ করা বিস্কুটে উচ্চমানসম্পন্ন পুষ্টি থাকে। এমনিতে আমাদের শিশুরা পুষ্টিহীনতায় ভোগে। এসব বিস্কুট খেলে তাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণ হয়। এর বাইরে শিশুদের ঝরে পড়ার হার কমে যায় ও খাদ্য বিতরণের কারণে স্কুলে এক ধরনের আনন্দ তৈরি হয়। এতে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিখন ফল বাড়ে।
রাশেদা কে চৌধুরী আরও বলেন, স্কুল ফিডিং কার্যক্রম বন্ধ হলে প্রাথমিকে এই তিনটি জিনিস হারিয়ে যাবে। শিশুরা শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়বে। দেশে বড় বড় মেগা প্রকল্প আছে, শিক্ষায় স্কুল ফিডিং একটি মেগা প্রকল্প হতে পারে।