শিক্ষকদের দ্বন্দ্বে দীর্ঘ ২১ বছর ধরে বন্ধ হয়ে আছে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। দিনে দিনে ধ্বংস হয়ে গেছে ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত ভবন। আগে বিদ্যালয়টির বিভিন্ন কক্ষে মাদক সেবন, জুয়া খেলা চললেও বর্তমানে বেদে সম্প্রদায়ের একটি পরিবার বসবাস করছে।
স্থানীয়রা বলছেন, নিজেদের শিক্ষক দাবি করা আটজন ব্যক্তির কারণে বর্তমানে ওই এলাকার কমপক্ষে চার শতাধিক শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যার সংখ্যা ২১ বছরে ৮ হাজারের অধিক। ফলে ওই এলাকার নিরক্ষরতার হার অন্য এলাকা থেকে তিনগুণেরও বেশি।
বিদ্যালয় চালুর ব্যাপারে গত ২১ বছরেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি জেলা ও উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা। সঠিক কোনো তথ্যও নেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে।
বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার চাঁদপাশা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কোলচর শহীদ আফসার উদ্দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঘটনা এটি। এলাকাবাসীর দাবি, দ্রুত সময়ের মধ্যে বিদ্যালয়টি চালু করে কোলচরের শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হোক।
চাঁদপাশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেলায়ার হোসেন রাঢ়ী বলেন, স্কুলটি বন্ধ থাকায় কোলচরের শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যারা স্বচ্ছল তারা হয়তো দূরে পাঠিয়ে লেখাপড়া করাতে পারেন, কিন্তু যারা গরিব তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার কোনো সুযোগ নেই। এখন ওই এলাকায় একটি আশ্রয়ণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানেও অসংখ্য শিশু রয়েছে। স্কুলটি যেকোনো উপায়ে চালু হওয়া দরকার।
জানা গেছে, ১৯৭৫ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আফসার উদ্দীনের নামে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয়। শুরুতে আবদুল করিম হাওলাদার নামে এক ব্যক্তিকে প্রধান শিক্ষক ও অন্য তিনজনকে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই সময় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বিবাদমান দুটি পক্ষের এক পক্ষ এক দিন স্কুলে আসলে অপর পক্ষ পরের দিন এসে স্কুল দখল করতেন। এই নিয়ে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে পরস্পর বিরোধী দুটি মামলা হলে ২০০১ সালে স্কুলটির শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। যেহেতু স্কুলটি শুরু থেকেই নিবন্ধিত ছিল, তাই ২০১৩ সালে জাতীয়করণ হয়। কিন্তু বিবাদমান দুটি পক্ষের কারণে সরকারি হওয়ার পরও স্কুলটি চালু করা সম্ভব হয়নি। বিদ্যালয়টি বন্ধ থাকায় প্রায় চার কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে অন্য স্কুলে পড়াশুনা করতে হয় কোলচরের কোমলমতি শিশুদের।
স্থানীয় বাসিন্দা ফারুক হোসেন বলেন, স্কুলটি বন্ধ থাকায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা। আমার সন্তান আছে কিন্তু স্কুলে পড়াতে তাকে দুই-তিন কিলোমিটার দূরে যেতে হয়। এজন্য প্রতিদিন সে স্কুলে যেতে পারে না।
মোহাম্মদ কামাল হোসেন রাঢ়ী নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, আমি এই স্কুলে লেখাপড়া করেছি। কিন্তু স্কুলটি এত বছর ধরে স্বার্থান্বেষী দুটি মহলের কারণে বন্ধ হয়ে রয়েছে। সরকারের উচিত যেকোনো উপায়ে স্কুলটি চালু করা।
বাসিন্দা জুয়েল কাজী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি আবেদন জানাই কোলচরের মানুষের জন্য একটু সদয় হবেন। স্কুলটি আমাদের জন্য খুবই জরুরি। তিনি হস্তক্ষেপ করলে স্কুলটি চালু হতে পারে।
ব্যবসায়ী হাসান তালুকদার বলেন, দুই পক্ষ নিজেদের স্বার্থের কারণে স্কুলটি বন্ধ করে দিয়ে এই এলাকার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিয়েছে। আমি দাবি করছি, সেই দুই পক্ষের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। কারণ তারা নিজেদের জন্য জাতির ভবিষ্যৎ নষ্ট করছে।
মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) তার কার্যালয়ে গেলে তিনি কথা বলেননি। তবে সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল বলেন, দুই পক্ষের শিক্ষকদের বিবাদের কারণে স্কুলের পাঠদান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধের আগে যাছাই কমিটি চারজন শিক্ষককে নির্বাচিত করেন। এর বিপক্ষে গিয়ে অপরপক্ষ আদালতে মামলা দায়ের করেন।
তিনি বলেন, বিবাদমান শিক্ষকদের বাদ দিয়ে অন্য স্কুলের শিক্ষকদের প্রেষণে নিযুক্ত করে স্কুলটি চালুর চেষ্টা করে শিক্ষা অফিস। কিন্তু স্থানীয় ক্ষমতাশালীরা হুমকি দিয়ে নিযুক্ত শিক্ষকদের স্কুলে যেতে দিত না। এ কারণে চূড়ান্তভাবে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে ওই এলাকার শিক্ষার হার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।