মানুষের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন ব্রিটেনের রাজসিংহাসনে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করা রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা জানানো এবং বিশ্বনেতাদের স্মরণের মাধ্যমে রানিকে বিদায় জানানো হলো। সমাহিত করা হলো তার প্রয়াত স্বামী ডিউক অব এডিনবরার সঙ্গে। এমন একজন মানুষকে ব্রিটেনবাসী বিদায় জানাল যিনি ছিলেন সকল ধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে, দুর্নাম যাকে ছুঁতে পারেনি। আবেগঘন ও আড়ম্বরপূর্ণ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে গতকাল রানির শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। যার পরিকল্পনায় রানির নিজেরও অবদান ছিল। রানির শোক মিছিলে রাজা তৃতীয় চার্লসসহ রাজপরিবারের সদস্যরা অংশ নেন।
লন্ডনের কেন্দ্রস্থল ওয়েস্টমিনস্টার হলে সকাল ৮টায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রানির শায়িত অবস্থার সমাপ্তি ঘটে। এরপর ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের দরজা খুলে দেওয়া হয় এবং আমন্ত্রিত অতিথিরা আসেন। বেলা ১১টায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনসহ রানির জীবন ও কাজকে স্মরণ করেন। ব্রিটেনের জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীরাও অংশ নেন। ইউরোপের অন্যান্য রাজপরিবারের সদস্য এবং রানির আত্মীয়রাও এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
শেষকৃত্যানুষ্ঠানে রানির বিয়ের স্তোত্র পাঠ করা হয়। ১৯৪৭ সালে তৎকালীন প্রিন্সেস এলিজাবেথ এবং প্রয়াত প্রিন্স ফিলিপ মাউন্টব্যাটেনের বিয়ের অনুষ্ঠানে যে স্তবগান করা হয়েছিল, শেষকৃত্যানুষ্ঠানে সেটি গাওয়া হয়। রানি তার প্রিয় স্বামীকে হারান গত বছরের এপ্রিলে। তারা একসঙ্গে কাটিয়েছেন ৭০ বছর। এর আগে রানির জন্য ধর্মগ্রন্থ থেকে বাণী পাঠ করে শোনান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস এবং কমনওয়েলথের সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারনেস স্কটল্যান্ড।
পৌনে ১১টা নাগাদ ওয়েস্টমিনস্টার হল থেকে রানির কফিন রাষ্ট্রীয় শেষকৃত্যানুষ্ঠানের জন্য ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্যারিসন সার্জেন্ট মেজর অ্যান্ড্রু স্ট্রোক শোকযাত্রা শুরু করেন। চার দিন ধরে রানি ওয়েস্টমিনস্টার হলে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শায়িত ছিলেন। রাজপরিবারের সিনিয়র সদস্যরা, তাদের মধ্যে নতুন রাজা, তার ছেলে প্রিন্স উইলিয়াম এবং প্রিন্স হ্যারি গান ক্যারিজ বা কামানবাহী গাড়িকে পদব্রজে অনুসরণ করেন। এই গাড়িতে রানির কফিন নিয়ে যাওয়া হয়। স্কটল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ড রেজিমেন্টের পাইপ এবং ড্রামবাদক দল এই শোভাযাত্রার অগ্রভাগে ছিল। আরো ছিল রয়্যাল এয়ার ফোর্স এবং গোর্খা সদস্যরা
রানির শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে ২ হাজার অতিথি ছিলেন ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে। এটা একটা রাষ্ট্রীয় শেষকৃত্য অনুষ্ঠান। এ ধরনের অনুষ্ঠান সাধারণত রাজা অথবা রানির জন্য করা হয়। এসব অনুষ্ঠানে কঠোর নিয়ম, রীতিনীতি মানতে হয়—যেমন সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণে শোভাযাত্রা এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শায়িত রাখা। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে একটা ঐতিহাসিক গির্জা। এখানেই ব্রিটেনের রাজা এবং রানিদের অভিষেক হয়। এখানেই ১৯৫৩ সালে রানির অভিষেক হয়েছিল। এই গির্জাতেই তত্কালীন প্রিন্সেস এলিজাবেথ ১৯৪৭ সালে প্রিন্স ফিলিপকে বিয়ে করেন। আঠারো শতকের পর এখানে কোনো রাজার শেষকৃত্য হয়নি। যদিও ২০০২ সালে রানির মায়ের শেষকৃত্য এখানেই হয়েছিল। এই রাষ্ট্রীয় আয়োজন পরিচালনা করেন ওয়েস্টমিনস্টারের ডিন ডেভিড হয়েল। সঙ্গে ছিলেন ক্যান্টারবারির আর্চবিশপ জাস্টিন ওয়েলবি। প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসও ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করেন।
বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটে শেষকৃত্যের শেষের দিকে সংক্ষেপে বিউগলের সুর বাজানো হয়। এরপর দুই মিনিট জাতীয়ভাবে নীরবতা পালন করা হয়। জাতীয় সংগীত এবং রানির বাঁশীবাদক দল বিষাদের সুর তোলেন। এরই মধ্যে দিয়ে দিনের মধ্যভাগে শোকসভা শেষ হয়। দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটে রানির কফিন নিয়ে একটা শোভাযাত্রা হেঁটে হেঁটে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে থেকে ওয়েলিংটন আর্চ, লন্ডনের হাইড পার্কের কোনায় যায়। এই রাস্তায় সেনাবাহিনীর সদস্য ও পুলিশ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। বিগ বেন থেকে এক মিনিট পরপর ঘণ্টা ধ্বনি করা হয়। শোভাযাত্রাটি খুব ধীরে ধীরে রাজধানীর রাস্তা দিয়ে যায়। হাইড পার্ক থেকে প্রতি মিনিটে তোপধ্বনি করা হয়। সাধারণ মানুষ এই শোভাযাত্রা কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে দেখতে পান। এই শোভাযাত্রাটি রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ নেতৃত্ব দেয়। শোভাযাত্রাটি সাতটা ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রতিটা ভাগের অগ্রভাগে ছিল আলাদা বাদকদল। যুক্তরাজ্য এবং কমনওয়েলথের সৈন্যবাহিনী শোভাযাত্রায় ছিল। পুলিশ, ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত ছিল। রাজা আরো এক বার রাজপরিবারের সদস্যদের নেতৃত্ব দেন। কুইন কনসর্ট ক্যামিলা, প্রিন্সেস অব ওয়েলস, কাউন্টেস অব ওয়েসেক্স এবং ডাচেস অব সাসেক্স শোভাযাত্রায় অংশ নেন গাড়িতে করে।
উইন্ডসর অভিমুখে যাত্রা: দুপুর ১টার সময় ওয়েলিংটন আর্চে আনুষ্ঠানিকতা শেষে রানির কফিন তোলা হয় রাষ্ট্রীয় শবযানে। গ্রেনেডিয়ের গার্ড বাহিনীর সদস্যরা রানির কফিন তুলে এই শবযানে রাখেন। এই গাড়িটি রওনা হয় উইন্ডসর প্রাসাদের দিকে। বিকাল ৩টা নাগাদ এটি উইন্ডসরে পৌঁছায়। বরাস্তার দুপাশে রানির শবযান দেখার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন হাজার হাজার মানুষ। প্রথমে মোটরওয়ে দিয়ে শবযান যাবে বলে পরিকল্পনা থাকলেও পরে এটির রুট পরিবর্তন করা হয়। এটি যায় বিভিন্ন এলাকার ভেতর দিয়ে যাওয়া রাস্তা ধরে, অনেক ছোট ছোট শহর কেন্দ্র হয়ে, যাতে আরো বেশি সংখ্যায় মানুষ রানির শবযান দেখার সুযোগ পান। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় মানুষ ফুল ছুঁড়ে দিয়ে তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান। রাজা এবং রাজপরিবারের সিনিয়র সদস্যরা উইন্ডসর ক্যাসেলের ভেতর কোয়ার্ডরেঙ্গেলের কর্টেজে যোগ দেন। প্রাসাদের সেবাস্টোপোল এবং কারফিউ টাওয়ারের ঘণ্টা প্রতি মিনিটে বাজানো হয়। প্রাসাদের প্রাঙ্গণ থেকে তোপধ্বনি করা হয়।
স্বামীর সঙ্গে সমাহিত রানি: সেন্ট জর্জ চ্যাপেলে কফিনটি নেওয়া হয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য। রাজপরিবারের সদস্যদের বিয়ে, দীক্ষা এবং শেষকৃত্য হয় এই গির্জায়। এখানেই ডিউক এবং ডাচেস প্রিন্স হ্যারি ও মেগানের বিয়ে হয়েছিল ২০১৮ সালে। রানির প্রয়াত স্বামী প্রিন্স ফিলিপের শেষকৃত্য হয়েছিল এখানে। অপেক্ষাকৃত কম মানুষ সমবেত হন এখানে। অনেকটা ব্যক্তিগত ধর্মসভা করা হয় যেখানে প্রায় ৮০০ অতিথি ছিলেন। এই ধর্মসভা উইন্ডসরের ডিন ডেভিড কনার পরিচালনা করেন। ক্যান্টারবারির আর্চবিশপ জাস্টিন ওয়েলবির আশীর্বাদ নিয়ে সভাটি হয়। রানির রাজত্বের শেষ হিসেবে নানা ঐতিহ্য প্রতীকী হিসেবে স্মরণভায় উপস্থাপন করা হয়। এসময় রানির মুকুট, রাজকীয় গোলক ও রাজদণ্ড শেষবারের মতো সরিয়ে নেওয়া হয় কফিন থেকে। এ সময় আরো কিছু আনুষ্ঠানিকতার পর রানির কফিন রয়েল ভল্টে নামানো হয়। বাঁশিবাদক দল প্রার্থনা এবং ‘গড সেভ দ্য কিং’ গানটি গান। বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে বলা হয়েছে, বাঁশিবাদক দলের এই পারফরম্যান্স রানি ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করে গিয়েছেন। বেলা ৪টা ৩৫ মিনিটে শেষকৃত্য অনুষ্ঠান শেষ হয়। রাজা এবং রাজপরিবারের সদস্যরা চ্যাপেল ছেড়ে যান। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় পারিবারিক ও ঘনিষ্ঠজনদের উপস্থিতিতে সেন্ট জর্জ চ্যাপেলের অভ্যন্তরে অবস্থিত রাজা ষষ্ঠ জর্জ মেমোরিয়াল চ্যাপেলে রানিকে তার প্রয়াত স্বামী ডিউক অব এডিনবরার সঙ্গে সমাহিত করা হয়। তার সমাধির ওপর মার্বেলের ফলকে খোদাই করে লেখা থাকবে ‘দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯২৬-২০২২’।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ব্রিটেনের সিংহাসনে ছিলেন ৭০ বছর ধরে এবং এই দীর্ঘ সময়কালে তিনি ব্রিটিশ জনগণের প্রাত্যহিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছিলেন। ব্রিটিশদের সেবা করার মধ্যেই গত ৮ সেপ্টেম্বর স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে প্রয়াত হন ৯৬ বছরের রানি। ১৯২৬ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ।