এখনো থমথমে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্ত পরিস্থিতি। গত শুক্রবার রাতে মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল বিস্ফোরণে সেখানে মোহাম্মদ ইকবাল (২৮) নামের এক রোহিঙ্গা যুবক নিহত হন। আহত হন আরও অন্তত আটজন। তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়ায় বাংলাদেশ ভূখণ্ডের শূন্যরেখায় এ ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
শনিবার রাতেও থেমে থেমে ভারী গোলা বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজে প্রকম্পিত হয়েছে সীমান্তের উভয় পার। সবশেষ গতকাল রোববার (১৮ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে থেমে থেমে গোলাবর্ষণ হয়। যা অব্যাহত ছিল সন্ধ্যা পর্যন্ত।
এ অবস্থায় সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে সীমান্তের আশপাশে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়নি সীমান্তরক্ষী বিজিবি। সীমান্ত বা তুমব্রু বাজারের কাছাকাছিও যেতে পারছেন না গণমাধ্যমকর্মী, ব্যবসায়ী বা বাইরের কোনো বাগান মালিক। পরিচয় দিয়ে স্থানীয়রা সীমিত পরিসরে যাতায়াতের সুযোগ পাচ্ছেন। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে ভয়ে তেমন কেউ ঘর থেকে বেরও হচ্ছেন না। জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা টহল। এ কারণে রাস্তাঘাটে কমেছে মানুষের উপস্থিতি।
তুমব্রু সীমান্ত এলাকার সিএনজি অটোরিকশা চালক রিদুয়ান আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ওপারে গোলাগুলি চলছে। মিয়ানমারের মর্টার শেলে সীমান্তে একজন নিহত হওয়ার পর সড়কে মানুষের আনাগোনা কমে গেছে। তবে পেটের দায়ে অনেকে বাধ্য হয়ে বের হচ্ছেন।
রাখাইনে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারি বাহিনীর সংঘাত চলছে অনেকদিন ধরেই। তবে সম্প্রতি এ পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। দেশটিতে চলমান সহিংসায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে সীমান্তবর্তী বাংলাদেশ অংশের বাসিন্দাদের মধ্যেও। ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে এরই মধ্যে দফায় দফায় তলব করা হচ্ছে। গতকাল রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খুরশেদ আলম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সংঘাতের জেরে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বারবার মর্টারের গোলা পড়ার ঘটনায় ঢাকা সতর্ক হলেও সীমান্তে এখনই সেনাবাহিনী মোতায়েনের কথা ভাবছে না। তবে সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে সব সংস্থাকে সজাগ থাকতে বলা হয়েছে।
তুমব্রু এলাকার কৃষক জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্ত এলাকার অধিকাংশ মানুষ শ্রমজীবী। মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের কারণে আতঙ্কে সব পেশার মানুষ এখন কর্মহীন। যুদ্ধবিমান থেকে গোলা নিক্ষেপ, দিনরাত গোলাগুলির শব্দেও গত প্রায় একমাস জীবনযাত্রা মোটামুটি স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু গত শুক্রবার মর্টার শেল এসে রোহিঙ্গা তরুণ নিহত হওয়ার পর চরম আতঙ্ক ভর করেছে সবার মাঝে। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে, কৃষক মাঠে যেতে, ব্যবসায়ীরা দোকানপাট খুলতে ভয় পাচ্ছে। উপার্জন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে সীমান্তবাসীর।
নাইক্যংছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জামাল হোসেন বলেন, ১৯৭২ সালের পর থেকে মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে এদেশে পালিয়ে এসেছে রোহিঙ্গারা। তারা আগে দেখাতো বিদ্রোহী সংগঠন আরএসওর সঙ্গে সংঘাত। কিছুদিন আগে দেখিয়েছে আরসা ও আল-ইয়াকিনের সঙ্গে সংঘর্ষ। এখন দেখাচ্ছে আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘাত। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এটি তাদের সাজানো নাটক। ২০১৭ সালের পর যেসব রোহিঙ্গা ওপারে রয়ে গেছে তাদের সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশ বা অন্যদেশে পাঠিয়ে দিতে তারা এখন গোলাবারুদে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।
তুমব্রু এলাকার বাসিন্দা হাফিজুল ইসলাম বলেন, ঘণ্টাখানেক পর পর মিয়ানমারের সীমান্ত ঘেঁষে ভারী অস্ত্র বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে। রাতের বেলা এ অস্ত্রে আগুন দেখা যায় আকাশে। বিকট শব্দে তুমব্রু সীমান্তের এপারের মাটির দেয়াল, কাঁচের জানালা, পুরাতন বা সেমিপাকা বাড়ির দেয়ালে ফাটল দেখা দিচ্ছে। থমথমে পরিস্থিতিতে অনেকটা ঘরবন্দি সীমান্তের মানুষ।
এদিকে স্থানীয় মানুষের জীবনের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভিন তিবরিজী।
সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতিতে নাইক্ষ্যংড়ি উপজেলা প্রশাসন আতঙ্কিত সাধারণ মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সীমান্তবাসীর পাশে থেকে কাজ করছে উপজেলা প্রশাসনও।
গতকাল রোববার (১৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের মধ্যে বৈঠক হয়। ইউএনও সালমা ফেরদৌসের সভাপতিত্বে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকের বিভিন্ন সুপারিশনামা লিখিত আকারে জেলা প্রশাসক বরাবর পাঠানো হবে। এমনটিই জানিয়েছেন নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য তসলিম ইকবাল চৌধুরী।
তিনি বলেন, সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। সাধারণ মানুষকে নিরাপদে রাখতে এবং চলমান এসএসসি পরীক্ষার্থীদের সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা সম্পন্ন করতে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এবং জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে উপজেলা প্রশাসন কাজ করছে।
এ বিষয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সালমা ফেরদৌস জাগো নিউজকে বলেন, সীমান্তের সার্বিক পরিস্থিতি সার্বক্ষণিকভাবে জেলা প্রশাসককে অবহিত করা হচ্ছে এবং স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে আছে। বিজিবি টহল জোরদার করা হয়েছে। তুমব্রু সীমান্তবাসীদের অভয় ও নিরাপত্তা দিতে কাজ করছে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রশাসন।