মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা (এমপি) পদত্যাগ না করে নির্বাচনে যাওয়ার সুযোগ গ্রহণ করলে অন্য প্রার্থীদের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার সমান ক্ষেত্র নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। এটা লেভেল-প্লেইং ফিল্ডের অন্তরায়। যে কারণে সুষ্ঠু, অবাধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এ সুযোগটি রহিত করে আইনি সংস্কার প্রয়োজন।
বৃহস্পতিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন : গণতান্ত্রিক সুশাসনের চ্যালেঞ্জ উত্তরণে করণীয়’ শীর্ষক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এ মত প্রকাশ করে।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
এতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আগামী নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা। সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় লেভেল-প্লেইং ফ্লিড নিশ্চিত করা। এজন্য আইনি সংস্কার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি।
তিনি বলেন, আস্থা যদি অর্জন করতে হয়, তাহলে নির্বাচন কমিশন ঠিক করবে কী করণীয়। তবে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে মন্ত্রী-এমপি হিসেবে বহাল থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ফলে লেভেল-প্লেইং ফ্লিড নষ্ট হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর এক ধরনের চাপ থাকে। সে কারণে লেভেল-প্লেইং ফ্লিড তৈরি করা সম্ভব হয় না।
দ্বিতীয়ত নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। সে বিষয়টি কীভাবে নিরপেক্ষ করা যায় সেটা ভেবে দেখা দরকার। আরেকটি বিষয় হচ্ছে নির্বাচন কমিশন যে রোডম্যাপ প্রকাশ করেছে, সেখানে অংশীজনের কথা বলা হয়েছে। অংশীজনের তথ্য সরবরাহসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি যেন না হয় সে বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকে নিশ্চিত করতে হবে। কারণ আমরা আগের নির্বাচনে ইন্টারনেটকে ব্যবহার করে প্রতিবন্ধকতা তৈরির উদাহরণ দেখেছি, বলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।
টিআইবি’র প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা, স্বচ্ছ ভোট বাক্স বা ইভিএমের ব্যবহারসহ সবকিছুই অর্থহীন হয়ে পড়ে যদি সব রাজনৈতিক দলের জন্য সুষ্ঠু, অবাধ প্রতিযোগিতার সুযোগ না থাকে। ভোটার ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখতে পান তার ভোটটি আগেই দেওয়া হয়ে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভোটারদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ভোটকেন্দ্রে সব দলের প্রতিনিধির উপস্থিতির সুযোগ নিশ্চিত করা হয় না এবং ভোট গণনার সময় তাদের উপস্থিতিও নিশ্চিত করা হয় না। দশম এবং একাদশ উভয় সংসদ নির্বাচনের সময়ই অত্যন্ত জোর দিয়ে টিআইবি বলেছিল, প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় একজন সংসদ সদস্য বিদ্যমান থাকা অবস্থায় নতুন সংসদ সদস্য পদের জন্য নির্বাচনে পক্ষপাত বা প্রভাব বিস্তারের সুযোগ ও ঝুঁকি সৃষ্টি করে। সাম্প্রতিক সময়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিতর্কিতভাবে কয়েকটি কেন্দ্রের ফল দেরিতে ঘোষণার মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকেই নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। তাই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে সমতার সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে পঞ্চদশ সংশোধনীর সংশ্লিষ্ট ধারা বাতিল করে পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে হবে। প্রয়োজনে আইনি সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারের কার্যক্রম সীমিত রুটিন কাজে সীমাবদ্ধ করা যেতে পারে।
কোটি কোটি টাকার মনোনয়ন বাণিজ্যের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে টিআইবি বলছে, ২০১৮ সালের নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমনকি বিদেশে বসেও কোটি কোটি টাকার মনোনয়ন বাণিজ্য পরিচালনার অভিযোগ এসেছে। টাকার বিনিময়ে যদি প্রার্থী মনোনয়ন লাভ করে তাহলে সংসদে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার বিষয়টি অপ্রধান হয়ে ওঠার ঝুঁকি সৃষ্টি হয় এবং যারা প্রকৃতপক্ষে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা মূলেই বিনষ্ট হয়ে যায়। নির্বাচনকে অর্থবহ ও জনগণের প্রতিনিধিত্বশীলতার ক্ষেত্রে কার্যকর করতে নির্বাচনী মনোনয়নকে দুর্নীতিমুক্ত করে তৃণমূল পর্যায়ের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
টিআইবি মনে করে, যদি সব দলের আস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদেরকে নির্বাচনে নিয়ে আসার জন্য আইনগত পরিবর্তন বা সংস্কার প্রয়োজন হয় তাহলে নির্বাচন কমিশনকে সে কথা স্পষ্টভাবে সরকারকে জানিয়ে দিতে হবে। বিদ্যমান আইনি কাঠামোর বিভিন্ন ঘাটতি, যা নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করবার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা সৃষ্টিতে বাধা দেয়, সেগুলো দূর করার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করা নির্বাচন কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক ও নৈতিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।
একইভাবে ইভিএম সম্পর্কে কমিশনের সিদ্ধান্ত কমিশনের প্রতি আস্থা সৃষ্টির ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। এরইমধ্যে নির্বাচন কমিশন ভোটগ্রহণের জন্য এবার সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় অধিকাংশ পক্ষ ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন। অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইভিএম ব্যবহারের এই সিদ্ধান্ত কতটুকু সুনির্দিষ্ট অবদান রাখবে এবং সুনির্দিষ্টভাবে সেগুলো কী কী সে সম্পর্কে জানার অধিকার দেশের ভোটারদের রয়েছে।
আইনি সংস্কারের প্রসঙ্গে টিআইবির প্রবন্ধে বলা হয়েছে, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ না করে নির্বাচনে যাওয়ার সুযোগ গ্রহণ করলে অন্য প্রার্থীদের সঙ্গে তাদের প্রতিযোগিতার সমান ক্ষেত্র নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
এছাড়া আইনি সংস্কারের সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, নির্বাচনকালীন সময়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পদায়ন ও বদলির ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক করা; নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরবর্তী তিন মাস পর্যন্ত নির্বাচনকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদেরকে (যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে) কমিশনের অধীনে রাখা; তৃণমূল থেকে মনোনয়ন দেওয়া প্রার্থীদের মধ্য থেকেই মনোনয়ন দেওয়া বাধ্যতামূলক করা; আচরণ বিধি লঙ্ঘন সংক্রান্ত শাস্তির ক্ষেত্রে আইনে সব ধরনের অসামঞ্জস্যতা দূর করা (যেমন এখনো গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আইন ১৯৭২ এবং নির্বাচনী আচরণ বিধিমালায় একই ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান লক্ষ্য করা যায়), রাজনৈতিক দলের আর্থিক বিবরণী প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা এবং প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ব্যয়ের রিটার্ন যাচাই-বাছাই করার ব্যবস্থা সংক্রান্ত ধারা নির্বাচনী আইনে অন্তর্ভুক্ত করা।
ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনটি পরিচালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম।