করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর আগে সর্বশেষ বিদেশ ভ্রমণ করেছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এরপর প্রায় এক হাজার দিন চীনের বাইরে আর বের হননি পরাশক্তি এই দেশটির প্রেসিডেন্ট। এতে করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যবস্থায় ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়েছে চীন।
তবে আবারও মাঠে নামতে চলেছেন জিনপিং। আর সেটিও এই সপ্তাহেই। মূলত চলতি সপ্তাহেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আবারও বিশ্ব মঞ্চে আবির্ভূত হচ্ছেন চীনা প্রেসিডেন্ট। বুধবার (১৪ সেপ্টেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ।
ক্রেমলিন জানিয়েছে, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বৃহস্পতিবার বৈঠক করবেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর থেকে উভয় নেতা এদিনই প্রথম মুখোমুখি ব্যক্তিগত বৈঠকে বসতে চলেছেন।
মূলত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কটিকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসাবে দেখছে বেইজিং। উভয় নেতা উজবেকিস্তানে চীনা-প্রতিষ্ঠিত নিরাপত্তা ফোরামের সম্মেলনের অবসরে বৈঠক করবেন। এই সম্মেলনে ভারত থেকে ইরান পর্যন্ত অনেক দেশের নেতা একত্রিত হবেন এবং এই ফোরামের লক্ষ্য একটি বহুমুখী বিশ্ব ব্যবস্থা গঠনকে ত্বরান্বিত করা।
তবে এর আগে বুধবার কাজাখস্তানে থামবেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এই দেশটিতে তিনি নয় বছর আগে তার স্বাক্ষরিত বেল্ট-অ্যান্ড-রোড বাণিজ্য-ও-অবকাঠামো পরিকল্পনাটি উন্মোচন করেছিলেন। সেই পররাষ্ট্র-নীতি উদ্যোগটি তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের জোট গ্রুপ অব সেভেনের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
উভয় দেশে জিনপিংয়ের এমন একটি সফর তার দৃষ্টিকে আরও শক্তিশালী করবে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বা সামরিক চাপের হুমকি ছাড়াই বেইজিংয়ের স্বার্থ প্রসারিত করতে পারে চীন। এছাড়া চীনের শীর্ষ এই নেতা আগামী মাসে কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে সেই এজেন্ডা ব্যাখ্যাও করবেন। সেখানেই তিনি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির নেতা হিসাবে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
গবেষণা সংস্থা ট্রিভিয়াম চায়নার সহ-প্রতিষ্ঠাতা ট্রে ম্যাকআর্ভার বলেছেন, ‘শি জিনপিং এমন একটি দিক দিয়ে বৈশ্বিক বিষয়গুলোকে পুনর্নির্মাণ করার চেষ্টা করছেন; যা পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিকেন্দ্রীকরণ করবে। এছাড়া জিনপিংয়ের এই কৌশল গ্রুপিং এবং এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রচার করে যা চীনের স্বার্থ ও বিশ্বদর্শনের পক্ষে বেশি অনুকূল।’
পুতিনের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট জিনপিংয়ের বৈঠক নিয়ে তিনি বলেন, ‘এটি (পশ্চিমাদের) খুব স্পষ্টভাবে এই সংকেত দিচ্ছে যে, চলমান বৈশ্বিক সংঘাতে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকছে চীন।’
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাথে দেখা করার জন্য বেইজিং সফর করেছিলেন। তবে ঠিক সেই সময়ই রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর ট্যাংকগুলো ইউক্রেনের সীমান্তে জড়ো হচ্ছিল। উভয় নেতা সেসময় তাদের অংশীদারিত্বে ‘কোনো সীমা’ না রাখার ব্যাপারে সম্মত হন।
অর্থাৎ রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ করার কয়েক সপ্তাহ আগে ‘সীমাহীন’ বন্ধুত্ব ঘোষণা করেছিলেন পুতিন ও জিনপিং। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনে বেশ চাপে পড়েছেন পুতিন। সেখানে পশ্চিমা অস্ত্রে সজ্জিত ইউক্রেনীয় বাহিনী রাশিয়ান সেনাদের পিছু হটতে বাধ্য করছে এবং রুশ বাহিনীর কাছ থেকে বিশাল ভূখণ্ড পুনর্দখলও করতে সক্ষম হয়েছে কিয়েভ।
তবে এরপরও চীন এখন পর্যন্ত এমন কিছু করা থেকে এড়িয়ে গেছে; যা চীনকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় ফেলতে পারে বা রাশিয়াকে যুদ্ধে জয়ী হতে সাহায্য করে। অবশ্য বেইজিং পুতিনকে কূটনৈতিক সমর্থন দিয়েছে এবং তার উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিবেশীর সাথে বাণিজ্য বাড়িয়েছে। মূলত রাশিয়াকে সাহায্য করার জন্য চীনের আগ্রহ যুক্তরাষ্ট্রের নেওয়া পদক্ষেপগুলোকে ছুঁড়ে ফেলার মতোই মনে হচ্ছে, যা একদিন হয়তো বেইজিংয়ের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করা হতে পারে।
কাজাখস্তানের একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত নিবন্ধে শি জিনপিং বলেছেন, দুই দেশের (চীন ও রাশিয়ার) উচিত এমন একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে যৌথভাবে এগিয়ে নেওয়া যা আরও যৌক্তিক এবং আরও ন্যায়সঙ্গত। শীর্ষ চীনা কূটনীতিক ইয়াং জিচি এই সপ্তাহের শুরুতে বিদায়ী রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত আন্দ্রে ডেনিসভের সঙ্গে বৈঠকেও একই ধরনের ভাষা ব্যবহার করেছিলেন।
ব্যাংক অব ফিনল্যান্ড ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিস ইন ট্রানজিশনের গবেষণা প্রধান আইক্কা কোরহোনেন বলেছেন, ‘যুদ্ধের সময় রাশিয়াকে অস্ত্র বা উন্নত ইলেকট্রনিক্স সরবরাহের জন্য চীন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তারা এই ধরনের কাজ না করার বিষয়ে সচেতন, অন্তত সুস্পষ্ট কোনো উপায়ে নয়। তাই এই তথাকথিত মিত্ররা কী করতে প্রস্তুত তার সীমাবদ্ধতা রয়েছে।’
মস্কো যুদ্ধের জন্য চীনের সমর্থন রয়েছে বলে ঘোষণা করার চেষ্টা করেছে। গত সপ্তাহে মস্কো চীনের ৩ নম্বর কর্মকর্তা লি ঝানশুকে উদ্ধৃত করে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। এতে রাশিয়ান আইনপ্রণেতাদের বলা হয়, বেইজিংয়ের নেতারা ‘রাশিয়ার মূল স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে গৃহীত সকল পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা সম্পূর্ণরূপে জানেন, আর (রাশিয়াকে) আমরা আমাদের সহায়তা প্রদান করছি।’
রুশ বার্তাসংস্থা তাস এর প্রতিবেদন অনুসারে লি ঝানশু আরও বলেছেন, রাশিয়া ও চীন সামরিক জোট ন্যাটোর সম্প্রসারণ এবং দুই দেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন কর্মকাণ্ড মোকাবিলায় প্রচেষ্টা আরও বাড়াবে।
লির ভাষায়, ‘আমরা তাদের আধিপত্য এবং শক্তি প্রয়োগের নীতির বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াই করব।’ অবশ্য লি ঝানশুর এসব মন্তব্য চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা চীনা রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি।
সেখানে পুতিন বলেন, ‘পশ্চিমা দেশগুলো পুরোনো বিশ্বব্যবস্থা রক্ষা করতে চাইছে; যা তাদের উপকার করে এবং সবাইকে কুখ্যাত ‘নিয়ম’ অনুযায়ী জীবনযাপন করতে বাধ্য করে, যা তারা নিজেরাই তৈরি করেছে।’
সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের সম্মেলনেও উভয় দেশ একই ধরনের মনোভাব প্রকাশ করতে পারে। আগামী ১৫ এবং ১৬ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ-পূর্ব উজবেক শহর সমরখন্দে বৈঠকে মিলিত হবেন এই গ্রুপের নেতারা। এছাড়া চীনের প্রতিষ্ঠিত এই গ্রুপটি বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ এবং বৈশ্বিক মোট দেশজ উৎপাদনের ২৫ শতাংশ বহন করে।
সিঙ্গাপুরের নানয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির এস. রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো রাফায়েলো পান্তুচির মতে, সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের এই সম্মেলনে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের উপস্থিতি মার্কিন শক্তির একটি বিকল্প ধারণাকে আরও শক্তিশালী করবে, যাতে ভারত ও তুরস্কের মতো পশ্চিমা-সংযুক্ত রাষ্ট্রগুলোও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে ভারত এবং তা বিশেষত চীনবিরোধী কোয়াড জোটের মাধ্যমেই। ভারতের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানও কোয়াডের সদস্য। যদিও সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) বৈঠকের তাৎপর্য বেশ প্রতীকী, তবে এই গ্রুপটির মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্কও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারতের মতো দেশগুলোর জন্য সস্তা জ্বালানির উৎস হয়ে উঠেছে রাশিয়া।
ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও মস্কোর সাথে চীনের বাণিজ্য সম্পর্ক আরও প্রসারিত হয়েছে: বছরের প্রথম পাঁচ মাসে চীনে রাশিয়ার রপ্তানি প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে ৪০.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পেঁছৈছে বলে আইএমএফের তথ্যে উঠে এসেছে। বাণিজ্যের বড় অংশটিই হয়েছে তেল এবং গ্যাস কেন্দ্রীক।
মস্কোর হাইয়ার স্কুল অব ইকোনমিক্স-এর রাশিয়া-চীন সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ ভ্যাসিলি কাশিন বলেছেন, নিষেধাজ্ঞার ফলে পশ্চিমা পণ্যের অনুপস্থিতির কারণে যে শূন্যতা দেখা দিয়েছে তা পূরণ করতে চীনের সাথে বাণিজ্য আরও সম্প্রসারণ করতে এবং আরও শিল্প ও প্রযুক্তিগত পণ্য আমদানি করার জন্য শি জিনপিংয়ের সাথে আলোচনা করার লক্ষ্য রেখেছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। গাড়ি, টেলিভিশন এবং স্মার্টফোনের মতো চীনা পণ্য রপ্তানি রাশিয়াকে শূন্যতা পূরণ করতে সাহায্য করেছে কারণ (নিষেধাজ্ঞার কারণে) বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো মস্কো ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
এছাড়া চীন রাশিয়ান তরলীকৃত-প্রাকৃতিক-গ্যাসের (এলএনজি) আমদানীও অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে কারণ বেশিরভাগ আমদানিকারকরা রুশ জ্বালানি থেকে দূরে সরে গেছে। শিপ-ট্র্যাকিং ডেটা অনুসারে, গত আগস্টে চীনে রুশ এলএনজি সরবরাহ প্রায় দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে।
আগামী নভেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে গ্রুপ অব ২০ বা জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। আর সেই সম্মেলনের আগে উজবেকিস্তান এবং কাজাখস্তানে শি জিনপিংয়ের এই সফর রাজনৈতিকভাবে তাকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ফিরে আসতেও সহায়তা করবে।
লন্ডনের এসওএএস ইউনিভার্সিটির চায়না ইনস্টিটিউটের পরিচালক স্টিভ সাং-এর মতে, করোনা লকডাউনের পর জি-২০ সম্মেলনকে নিজের প্রথম বিদেশ সফর বানানোর পরিবর্তে ‘বন্ধু এবং অংশীদারদের’ সঙ্গে ব্যস্ততাকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছেন শি জিনপিং।
তিনি বলছেন, ‘চীন এবং শি জিনপিং কার্যকরভাবে এই সফরের এজেন্ডা নির্ধারণ করতে পারে, আর সেটি এমন কিছু যা তারা জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের জন্য নিশ্চিত করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়াকে সমান গুরুত্ব হিসাবে দেখা হয় না।’