রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু এবং নতুন রাজার অভিষেকে ব্রিটেনের অনেক কিছুই এখন বদলে যাবে। ৭০ বছরের বেশি সময় দ্বিতীয় এলিজাবেথ ব্রিটেনের সিংহাসনে ছিলেন। এই দীর্ঘ সময় ধরে তিনি ব্রিটেনের জনগণের প্রাত্যহিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিলেন।
স্থানীয় সময় গত বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যার পর রানির মৃত্যুর ঘোষণা দেয় বাকিংহাম প্যালেস। যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি এই রানি ৯৬ বছর বয়সে মারা যান।
গত সাত দশক ধরে ব্রিটেনের ডাকটিকিট, মুদ্রা, ব্যাংকনোট আর পাসপোর্টে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছবি দেখেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল পুরো বিশ্ব। কিন্তু রানির প্রয়াণ এবং নতুন রাজার সিংহাসনে আরোহণের মধ্য দিয়ে এর অনেক কিছুই এখন বদলে যাবে। কেমন হবে সেই পরিবর্তনগুলো?
বদলে যাবে মুদ্রা
যুক্তরাজ্যে এখন যত ধাতব মুদ্রা চালু আছে তার সংখ্যা ২ হাজার ৯শ কোটি এবং এর সবগুলোতেই রয়েছে রানির ছবি। এই মুদ্রার সবশেষ ডিজাইন করা হয় ২০১৫ সালে। তখন রানির বয়স ছিল ৮৮ বছর। তার রাজত্বকালে মুদ্রায় রানির প্রতিকৃতি পরিবর্তন করা হয়েছে মোট পাঁচবার।
ব্রিটেনের মুদ্রায় কবে থেকে পরিবর্তন আসছে তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে ধারণা করা হচ্ছে, রানির প্রতিকৃতি থাকা মুদ্রাগুলো আরও কয়েক বছর চালু থাকবে এবং এগুলো ধীরে ধীরে প্রতিস্থাপিত হবে।
নতুন মুদ্রায় রাজা তৃতীয় চার্লসের ছবিটি কেমন হবে তা এখনও বলা যাচ্ছে না। তবে ২০১৮ সালে তার ৭০তম জন্মদিন উপলক্ষে যে মুদ্রাটি বেরিয়েছিল তাতে কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায় যে সেটা দেখতে কেমন হতে পারে।
এক্ষেত্রে একটা বিষয় নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, চার্লসকে মুদ্রায় বামদিকে মুখ করে থাকতে দেখা যাবে। কারণ ঐতিহ্য হলো, মুদ্রায় কোন নতুন রাজা বা রানির ছবি ব্যবহারের সময় তিনি কোনদিকে তাকিয়ে আছেন তা পরিবর্তন করা হয়।
নতুন মুদ্রার ডিজাইন সরকারি অনুমোদন পাওয়ার পর তা দক্ষিণ ওয়েলসের লানট্রিসান্ট থেকে উৎপাদন শুরু করবে রয়্যাল মিন্ট। ১৯৬০ সাল থেকে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের সকল নোটে রানির ছবি রয়েছে। তবে স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের ব্যাংক নোটে রানির ছবি থাকে না।
বর্তমানে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের ইস্যু করা যত নোট বাজারে আছে তার সংখ্যা ৪৫০ কোটি। এর মোট মূল্য ৮ হাজার কোটি পাউণ্ড। ঠিক মুদ্রার মতই এই নোটগুলোও ধীরে ধীরে বাজার থেকে সরিয়ে নিয়ে তার জায়গায় নতুন নোট আনা হবে। তবে সকল নোটই বৈধ থাকবে এবং এতে কোনো পরিবর্তন হলে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড তা আগেই ঘোষণা দিয়ে জানাবে।
ডাকটিকিট ও ডাকবাক্স
ব্রিটেনের ডাক বিভাগ রয়্যাল মেইল ১৯৬৭ সাল থেকে যত ডাকটিকিট ইস্যু করেছে তার সবগুলোতেই রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রোফাইল বা একপাশ থেকে তোলা সিল্যুয়েট ছবি।রয়্যাল মেইল এখন নতুন রাজার ছবি সম্বলিত টিকিট তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করবে এবং রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছবিসহ ডাকটিকিট উৎপাদন বন্ধ করবে। তবে চিঠি-পার্সেলে এসব টিকিট ব্যবহারে কোনো বাধা থাকবে না।
ব্রিটেনে নতুন রাজার ছবিসম্বলিত ডাকটিকিট অবশ্য আগেই বেরিয়েছে। তবে রয়্যাল মেইল নতুন ডাকটিকিট দেখতে কেমন হবে তা জানায়নি।
ডাকটিকিট ছাড়াও রয়্যাল মেইল অনেক ডাকবাক্সের ওপর রাজকীয় প্রতীক উৎকীর্ণ করে থাকে। যুক্তরাজ্যের মোট ১ লাখ ১৫ হাজার ডাকবাক্সের ৬০ শতাংশের ওপর রাজকীয় চিহ্ন থাকে। এতে এলিজাবেথ এবং রেজিনা শব্দ দুটির সূচক ইংরেজি ‘ই’ এবং ‘আর’ অক্ষর দুটি আছে। কিন্তু স্কটল্যান্ডের ডাকবাক্সে থাকে স্কটিশ ক্রাউনের প্রতীক।
স্কটল্যান্ড ছাড়া অন্যত্র এখন নতুন ডাকবাক্সগুলোতে নতুন রাজার প্রতীক উৎকীর্ণ হবে। তবে এগুলো পেতে কিছুটা সময় লাগবে।
রাজকীয় অনুমোদনের সিলমোহর
টমেটো কেচাপ থেকে শুরু করে পারফিউম পর্যন্ত ব্রিটেনের অসংখ্য পণ্যের প্যাকেটে রাজকীয় অনুমোদনের সিলমোহর দেখা যায়। এতে লেখা থাকে বাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট টু হার ম্যাজেস্টি দ্য কুইন।
এগুলো হচ্ছে সেই সব পণ্য যা রাজকীয় ওয়ারেন্ট পেয়েছে অর্থাৎ তারা রাজ পরিবারের বাসভবনগুলোতে নিয়মিত পণ্য সরবরাহ করে থাকে।
গত ১০০ বছর ধরে ব্রিটেনের রাজা বা রানি তাদের স্ত্রী বা স্বামী এবং উত্তরাধিকারীরা ‘গ্র্যান্টর’ হিসেবে ৮শ কোম্পানিকে প্রায় ৯শ এমন অনুমতিপত্র দিয়ে এসেছেন।
নিয়ম অনুযায়ী গ্র্যান্টরদের কেউ মারা গেলে তাদের ইস্যু করা ওয়ারেন্টগুলো বাতিল হয়ে যায় এবং কোম্পানিকে দুবছরের মধ্যে এর ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হয়। রাজা তৃতীয় চার্লস এখন তার উত্তরাধিকারী প্রিন্স উইলিয়ামকে তার নিজস্ব রয়্যাল ওয়ারেন্ট ইস্যু করার ক্ষমতা দিতে পারবেন।
আগের পাসপোর্ট বৈধ থাকবে
বর্তমানে সব ব্রিটিশ পাসপোর্টই রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের নামে ইস্যু করা। রানির মৃত্যুর পরও এগুলো বৈধ থাকবে। তবে এখন থেকে নতুন পাসপোর্টে ইস্যু করা হবে রাজা তৃতীয় চার্লসের নামে। পুলিশের হেলমেটেও রাজকীয় প্রতীকে বদল ঘটবে।
আইনজীবীদের ক্ষেত্রেও আসবে পরিবর্তন। যে ব্যারিস্টার বা সলিসিটররা ‘কিউসি’ বা কুইন’স কাউন্সেল ছিলেন তারা এখন পরিচিত হবেন কেসি বা কিংস কাউন্সেল হিসেবে।
গড সেভ দ্য কিং
ব্রিটেনের জাতীয় সঙ্গীতের প্রথম লাইন হচ্ছে ‘গড সেভ দ্য কুইন।’ চার্লস আনুষ্ঠানিকভাবে রাজা ঘোষিত হওয়ার পর সেন্ট জেমসেস প্রাসাদ থেকে একটি ঘোষণা দেওয়া হবে যেখানে ‘গড সেভ দ্য কিং’ এই আহ্বান থাকবে। এখন থেকে জাতীয় সঙ্গীতের প্রথম বাক্য হবে- গড সেভ দ্য কিং। আর এভাবেই ১৯৫২ সালের পর এই প্রথম ব্রিটেনের জাতীয় সঙ্গীতেও পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।