আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রস্তুত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রোডম্যাপ অনুযায়ী, চলতি মাস থেকে নির্বাচন পর্যন্ত কী কী কার্যক্রম চলবে তা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এদিকে রোডম্যাপ প্রস্তুত করলেও ঠিক কতটি আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ হবে, তা এখন পর্যন্ত নির্ধারণ করতে পারেনি ইসি। ইসি কর্মকর্তারা ইভিএম নিয়ে একেক সময় একেক বক্তব্য দিচ্ছেন।
ইসির সঙ্গে সংলাপের সময় অধিকাংশ দল ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দিয়েছে। তবুও ইসি ইভিএম নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। রোডম্যাপে যদি ইভিএম নিয়ে কিছু না থাকে, তাহলে তা অসম্পূর্ণ রোডম্যাপ। তাছাড়া দেশের বিদ্যমান আর্থিক সংকটের মধ্যে নতুন ইভিএম কেনা খুবই দুঃখজনক।
দেশের ১৫০টি সংসদীয় আসনে এ যন্ত্র ব্যবহারের ঘোষণা দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়ে উঠবে কি না, তা নিয়ে ইসির মধ্যেই দ্বিমত রয়েছে। সবমিলিয়ে সংশ্লিষ্টরা এ রোডম্যাপকে অপরিপক্ব বলছেন।
সূত্র জানায়, সাতটি বিষয় প্রাধান্য দিয়ে এ মাসেই চূড়ান্ত রোডম্যাপ প্রকাশ করা হতে পারে। রোডম্যাপ অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর কিংবা ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। গত সংসদ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর।
ইসির রোডম্যাপ অনুযায়ী, এবার নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হবে। এজন্য আগের নীতিমালা পর্যালোচনা করে আগামী বছরের জানুয়ারিতে নতুন নীতিমালা তৈরি করা হবে।
২০২৩ সালের মার্চে নীতিমালার আলোকে বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় ৩০০ আসনে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে খসড়া প্রকাশ করবে ইসি।
২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারি সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। সে হিসেবে পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। যদি ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে নির্বাচন হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই নভেম্বরের ১৫ তারিখের মধ্যে তফসিল ঘোষণা করতে হবে। আর যদি নির্বাচন জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হয়, তাহলে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে তফসিল ঘোষণা করতে হবে।
অন্যদিকে নির্বাচনী আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা করা হবে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এছাড়া একই বছরের আগস্টে খসড়া ভোটকেন্দ্রের তালিকার ওপর দাবি আপত্তি নিষ্পত্তি করবে ইসি। ওই বছরের জুনেই নতুন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর জাগো নিউজকে বলেন, আমরা খসড়া রোডম্যাপ তৈরি করেছি। যেখানে থাকবে নির্বাচনের কর্মপদ্ধতি। সংসদ নির্বাচন কোন পন্থায় হবে ও কমিশনের ভূমিকা কী থাকবে রোডম্যাপে সেসব উল্লেখ থাকবে।
তিনি আরও বলেন, ২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারি সরকারের মেয়াদ শেষ হবে। সে হিসেবে পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। যদি ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে নির্বাচন হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই নভেম্বরের ১৫ তারিখের মধ্যে তফসিল ঘোষণা করতে হবে। যদি নির্বাচন জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হয়, তাহলে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে তফসিল ঘোষণা করতে হবে।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত ছয় মাসে প্রায় সবগুলো রাজনৈতিক দল, দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও অংশীজনদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে ইসি। এবার সবার কাছ থেকে পাওয়া মতামত-নির্দেশনা-পরামর্শের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা চূড়ান্ত কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যাবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।
ইসির কর্মপরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে- নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা, বিদ্যমান আইনি কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কার, সংসদীয় এলাকার সীমানা র্নিধারণ, নির্বাচন প্রক্রিয়া সময়োপযোগী করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সবার পরামর্শ নেওয়া, নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সরবরাহ।
আরও রয়েছে- বিধিবিধান অনুসরণ করে ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বৃদ্ধি কার্যক্রম চালু, অধিকতর প্রযুক্তির ব্যবহার, দক্ষ নির্বাচনী কর্মকর্তার প্যানেল তৈরি ও প্রশিক্ষণ, পর্যবেক্ষণ সংস্থা নিবন্ধন ও নবায়ন কার্যক্রম, নির্বাচনী কার্যক্রমে গণমাধ্যমকে আইনি কাঠামোর আওতায় সম্পৃক্তকরণ ও ভোটারদের সচেতনতা বৃদ্ধি কার্যক্রম।
ইসির পরিকল্পনার মধ্যে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে যে বিষয়টি, তা হলো- ভোটার সংখ্যা, জনশুমারি ও ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে জিআইএস পদ্ধতিতে নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ সংক্রান্ত ডাটাবেজ ও অ্যাপ্লিকেশন প্রণয়ন।
কর্মপরিকল্পনার মধ্যে আরও রয়েছে- আগামী মাসে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে সংলাপ। একই মাসে নির্বাচন পরিচালনা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সংলাপ, আগামী নভেম্বরে নারী নেতৃদের সঙ্গে সংলাপ। একই মাসে সুপারিশমালার খসড়া চূড়ান্তকরণ ও ডিসেম্বরে সুপারিশমালা চূড়ান্তকরণ।
ইভিএম নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা
প্রথমে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিয়েছিল, দেশের ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে।
এদিকে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, যদি সচিবালয় যথাসময়ে ইভিএম দিতে পারে, তাহলে ১৫০টি আসনে এ পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ হবে। যদি সচিবালয় সময়মতো দিতে না পারে তাহলে ৭০-৮০টি আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ হবে।
সর্বশেষ প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, রাজনৈতিক সমঝোতা হলে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। অথচ রোডম্যাপে ইভিএম সম্পর্কে কিছুই নেই।
ইসি একেকবার একেক কথা বললেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫০টি আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণের লক্ষ্যে নতুন প্রকল্প শুরু করেছে।
এ প্রকল্পের আওতায় প্রায় দুই লাখ ইভিএম মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রতি ইউনিট ইভিএমের প্রাথমিক দাম প্রায় ২ হাজার ৪০০ ডলার করে পড়বে ধারণা দেওয়া হয়েছে ইসি সচিবকে।
এছাড়া এ প্রকল্পে ইভিএম সংরক্ষণের জন্য ১৯টি জেলায় ওয়্যারহাউজ নির্মাণ ও মেশিন পরিবহনে পাঁচ শতাধিক গাড়ি কেনার প্রস্তাব করা হচ্ছে।
সব মিলিয়ে প্রাথমিকভাবে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল আট হাজার কোটি টাকার বেশি। কিন্তু গত ৭ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর জানা যায়, এ প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে। চলতি মাসেই সরকারের অনুমোদনের জন্য প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে।
ইভিএম প্রকল্পের পরিচালক সৈয়দ রাকিবুল হাসান ব্যয় বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে জাগো নিউজকে বলেন, ইভিএমগুলো সংরক্ষণের জন্য ওয়্যারহাউজ নির্মাণ করা হবে। প্রতিটি ওয়্যারহাউজ হবে ২১ হাজার বর্গফুটের।
ওয়্যার হাইজগুলোর জন্য ভূমি অধিগ্রহণ, যন্ত্রগুলো দেখভাল-পরিচালনার জন্য জনবল নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও পরিবহনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ খরচ হবে বলে দাবি করেন সৈয়দ রাকিবুল হাসান।
এসব বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ইসির সঙ্গে সংলাপের সময় অধিকাংশ দল ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দিয়েছে। তবুও ইসি ইভিএম নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, রোডম্যাপে যদি ইভিএম নিয়ে কিছু না থাকে, তাহলে তা অসম্পূর্ণ রোডম্যাপ। তাছাড়া দেশের বিদ্যমান আর্থিক সংকটের মধ্যে নতুন ইভিএম কেনা খুবই দুঃখজনক।