করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, কয়েক দশকরে মধ্যে তীব্র খরা-তাপপ্রবাহের কারণে ইউরোপজুড়ে জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। এতে একদিকে যেমন মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে অন্যদিকে কমছে প্রবৃদ্ধি। এমন পরিস্থিতিতে ইউরোপের অর্থনীতির ভবিষৎ নিয়ে বড় অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বেকায়দায় পড়ছে সরকারগুলো। ধারণা করা হচ্ছে, চলমান পরিস্থিতির মধ্যেই অঞ্চলটিতে অর্থনৈতিক মন্দা আসন্ন।
তবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কতটা খারাপ হবে তা নির্ভর করছে জ্বালানি সংকট ও নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তের ওপর। চলতি সপ্তাহে অঞ্চলটিতে জ্বালানির দাম অকল্পনীয়ভাবে বেড়েছে। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই অঞ্চলটিতে লাফিয়ে বাড়ছে মূল্যস্ফীতির হার। আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৯ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়ায়। বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। এর আগে রয়টার্সের জরিপে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের পূর্বাভাস দেওয়া হয়। গত নয় মাস ধরেই অঞ্চলটিতে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী, যা শুরু হয় ২০২১ সালের নভেম্বরে। জুলাইতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৯ শতাংশে।
ইউরোপীয় অর্থনীতি যুক্তিসঙ্গতভাবে শক্তিশালী অবস্থানে থাকার মধ্যেই সংকটে প্রবেশ করেছে। সেখানে তুলানামূলকভাবে শ্রমবাজার এখনো অনেক শক্তিশালী। বেকারত্বের হার মাত্র ছয় দশমিক ছয় শতাংশ। আসন্ন মাসগুলোতে মজুরি আরও বাড়বে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যুদ্ধ শুরু হওয়া পর ভোক্তাদের আত্মবিশ্বাস কমলেও ব্যয় কমেনি। তাছাড়া মূল্যস্ফীতির প্রত্যাশাও কিছুটা কমেছে।
তারপরও কয়েকটি কারণে আসন্ন মাসগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকি বাড়ছে। প্রথমত, কারখানাগুলো বর্তমানে চাপে রয়েছে। বসন্তে ইউরোপের উৎপাদকদের নেতারা যুক্তি দিয়েছিলেন যে রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হলে মহাদেশটিতে অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে আসবে।
তবে রাইন নদীর পূর্বের শিল্পগুলো সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার শিল্প নেতাদের সাম্প্রতিক সমীক্ষা সংকোচনের দিকে নির্দেশ করে। চীনা ক্রেতাদের ওপর জার্মানির অস্বাস্থ্যকর নির্ভরতা সমস্যা বাড়াচ্ছে। ইতালির শিল্প কারখানায়ও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পোল্যান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্র ইউরোজোনের বাইরে হলেও তারাও দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রম হলো হাঙ্গেরি। সেখানে উৎপাদন একটি সুস্থ গতিতে প্রসারিত হচ্ছে।
দ্বিতীয় সমস্যা হলো, ভোক্তাদের ব্যয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা। কারণ অঞ্চলটির অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে ভোক্তা ব্যয়। ফ্রান্স ও দক্ষিণ ইউরোপে ভোক্তা ও পর্যটকরা চলতি বছরের ছুটির মৌসুমে করোনা মহামারিতে সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করেছে। তবে মানুষ এখন দীর্ঘমেয়াদের সংকটের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এসএন্ডপি গ্লোবালের ক্রয় ব্যবস্থাপকের সূচক অনুসারে, রিয়েল এস্টেট ও পরিবহন গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার সঙ্গে আগামী মাসগুলোতে পরিষেবাগুলো স্থবির হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তৃতীয়ত, সুদের হার বাড়ার সঙ্গে ইউরোপে জ্বালানির মূল্য বেড়ে আকাশচুম্বী হয়েছে, যা ভবিষতে নিশ্চিতভাবে আরও বাড়বে। মূল্যস্ফীতি কমাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়েছে। বর্তমানের নয় দশমিক এক শতাংশ থেকে মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশে নামাতে চায় ব্যাংকটি।
সব পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইউরোপের অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। জেপি মরগান চেজের বিশ্লেষকরা জানিয়েছে, এ বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে সামগ্রিকভাবে ইউরো এলাকার বর্ষিক প্রবৃদ্ধির হার দুই শতাংশ, ফ্রান্স ও জার্মানির দুই দশমিক পাঁচ শতাংশ ও ইতালির তিন শতাংশ আশা করা হচ্ছে ৷ ইতালির সমস্যা ও উচ্চ ঋণ ইউরোপের বন্ড মার্কেটে ধাক্কা দিতে পারে।