রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যকার চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতি পুরো বিশ্বকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। বিশ্বজুড়ে অর্থনীতি এবং বিভিন্ন অঞ্চলসমূহ একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখার ক্ষেত্রে কঠিন সময় অতিক্রম করছে। এমনই এক পটভূমিতে, মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির সাম্প্রতিক তাইওয়ান সফর এ অঞ্চলে উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
তার এ সফর ওই অঞ্চল এবং পরিসীমার বাইরেও এক ধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে। পেলোসির এ সফর বিভিন্ন কারণে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিপর্যয়কর এবং আঞ্চলিক রাজনীতিতে শক্তিমত্তা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে দেশটির প্রভাবজনিত বিষয়টি এর মধ্যে অন্যতম।
এ অঞ্চলে যখন তাইওয়ান ইস্যুতে যথেষ্ট শান্তি বিরাজ করছে তখনই পেলোসির এই আকস্মিক পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোকেও অবাক করেছে। এমনকি চীনের বিরুদ্ধে এশিয়ায় মিত্রদের ধীরে ধীরে বোঝানোর জন্য বাইডেনের প্রচেষ্টাকেও এই সফর একটি ধাক্কা দিয়েছে। এক অর্থে এটি মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির জন্য বুমেরাং হয়েছে। অনেক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞও এ প্রসঙ্গে এক মত পোষণ করছেন।
দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই জো বাইডেন ওই অঞ্চলে চীনা প্রভাব হ্রাস করতে এবং আঞ্চলিক রাজনীতির টেবিলে তাদের প্রতিহত করতে এশিয়ায় একটি জোট গঠনের জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা
করে যাচ্ছেন।
বাইডেন আগ্রহী দেশগুলোকে এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যে, তাদের কোন পক্ষ বেছে নিতে হবে না। এ ধরনের আশ্বাস দেশগুলোর মধ্যে কোনো পরাশক্তিকে (যুক্তরাষ্ট্র বা চীন) হতাশ না করে একটি ভারসাম্যমূলক অবস্থান বজায় রাখার বিষয়ে আশা জাগিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন চীন সম্পর্কে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক ছিল এবং চীনা প্রযুক্তি জায়ান্টদের নিষিদ্ধ করার জন্য দেশগুলোকে চাপ দিয়ে আসছে।
এর বিপরীতে বাইডেন সুকৌশলে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং চীনকে বাদ দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাতটি দেশের সঙ্গে মিলে ইন্দো-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক কাঠামো গঠন করেছেন। এই জোট ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের একটি শক্তিশালী উপস্থিতির ইঙ্গিত দেয়, যা চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের বিকল্প জোট হিসেবে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই বিষয়গুলোই বিশ্বের এ অংশে চীনা প্রভাবকে হ্রাস করতে পারতো।
এ সব কূটনৈতিক কৌশলের পর যখন এই অঞ্চলে মার্কিন মিত্ররা যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টার সঙ্গে একই পথে হাঁটছে, তখন মনে হচ্ছে পেলোসির এই সফর সবকিছুকে নষ্ট করে দিয়েছে। যদিও বাইডেন বলেছেন, হোয়াইট হাউজ পেলোসির সফরকে সমর্থন করে না এবং তার দাবি খোদ প্রেসিডেন্টেরও পেলোসিকে তাইওয়ান সফর থেকে বিরত রাখার এখতিয়ার নেই।
এই সফর আসলে এশীয় দেশগুলোকে বিভ্রান্ত করেছে এবং তাদের বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছে। এ বিষয়ে কেউ কেউ তাদের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং কিছু দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং অনেক মার্কিন মিত্র দেশ এ বিষয়ে কিছু বলা থেকে বিরত রয়েছে।
আপাতদৃষ্টিতে জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়ার জন্য চীনের প্রতি সক্রিয়ভাবে নিন্দা জ্ঞাপন করেছে। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার নেতারা এই আকস্মিক সফরের জন্য পেলোসির সমালোচনা করেছেন। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর আঞ্চলিক জোট আসিয়ান এক চীন নীতির প্রতি তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে। বেশিরভাগ দেশই ‘এক চীন নীতি’-তে তাদের আস্থা রেখেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়োন সুক-ইওল ছুটিতে থাকার অজুহাতে তাইওয়ানে তার বিতর্কিত সফরের পর পেলোসির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানান বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে বেশিরভাগ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এই উস্কানিমূলক পদক্ষেপের কারণে চীন যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তা আগে থেকেই বুঝতে পেরেছে। ভারতও (চীনের সঙ্গে দেশটির দ্বন্দ্ব রয়েছে) প্রকাশ্যে এই সফরকে সমর্থন করেনি। এর অর্থ চীনের সঙ্গে তারা তাদের সম্পর্কের আর অবনতি ঘটাতে চায় না।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাম্প্রতিক সময়ের এক বিবৃতিতে স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের জন্য একতরফাভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ না করা, উত্তেজনা হ্রাস এবং এ অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। একই সময়ে তারা ‘এক চীন নীতি’র প্রতি তাদের সমর্থনও পুনর্ব্যক্ত করেছে।
সত্যিকার অর্থে, এই সফরের বেশ কয়েক দিন পর এখন মনে হচ্ছে পেন্ডুলামটি চীনের দিকে ঝুলছে; কারণ দেখা যাচ্ছে প্রায় ১৭০টি দেশ বিভিন্ন ভাবে তাইওয়ান প্রশ্নে চীনের পক্ষে দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছে। তারা যুক্তরাষ্ট্র এবং তার কিছু অনুসারীদের বিপক্ষে একটি অপ্রতিরোধ্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা গঠন করেছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে শান্তির পথ অনুসরণ করেছে। কারণ দেশটি ‘এক চীন নীতি’ মেনে চলার বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেছে।
দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতিতে গত ৩ আগস্ট চীনের অবস্থানের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করে জানিয়েছে, আমরা এক চীন নীতিতে বিশ্বাস করি। আমরা চাই না পরিস্থিতির অবনতি হোক। কারণ বিশ্ব প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
একটি বিষয় পরিষ্কার যে, ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর কৌশলগতভাবে ভুল ছিল। এই উস্কানিমূলক সফরটি খুব সহজেই এড়ানো যেত। এই সফরকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা বৃদ্ধির বিষয়টি প্রমাণ করে যে, এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সুসংগত এবং স্পষ্ট চীনা নীতির অভাব রয়েছে যা যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
পেলোসির সফরের পরপরই চীন তাইওয়ানের চারপাশে বিশাল সামরিক মহড়া চালাতে শুরু করে। এই সফরের কারণে সৃষ্ট উত্তেজনা এখনও প্রশমিত হয়নি। ইতোমধ্যে চীন তার সামরিক মহড়ার
গতি বাড়িয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে কোনো উপায়ে উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড এড়াতে হবে। বিশ্ব ইতোমধ্যেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। এমন অবস্থায় আঞ্চলিক সম্প্রীতি ও স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করে এমন যে কোনো পদক্ষেপ এড়ানো অপরিহার্য।
লেখক: ঝৌ ইংমেং, ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক, ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অব বাংলাদেশ স্টাডিজের পরিচালক। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেছেন এবং যুক্তরাজ্যের চাথাম হাউসের একজন ভিজিটিং ফেলো। গবেষণার ক্ষেত্রে তার আগ্রহের বিষয়-বাংলাদেশ অধ্যয়ন, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক এবং চীনের প্রতিবেশী দেশগুলোর কূটনীতি।