বাংলাদেশ আগে কখনো পারেনি নিউজিল্যান্ডের মাটিতে। এবারও পারলো না। যদি কেউ এভাবে দেখেন, তাহলে বলার কিছু নেই। কিন্তু কঠিন সত্য হলো গল্পের পেছনেও যেমন গল্প থাকে, কাহিনীর অন্তরালে থাকে ভিন্ন কাহিনী- এবার বাংলাদেশ দলের নিউজিল্যান্ড সফরেও আছে তেমন গল্প। নানা কথা-বার্তা।
সমান তিনটি করে ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি। সবকটাতেই হেরেছে তামিম, মাহমুদউল্লাহ আর লিটনের দল। ক্রাইস্টচার্চে দ্বিতীয় ওয়ানডে আর নেপিয়ারে দুই নম্বর টি-টোয়েন্টি ম্যাচ দুটিতে তবু কিছু প্রতিদ্বন্দ্বীতা হয়েছে। ওই দুই ম্যাচে মোটামুটি লড়াই করে হেরেছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া পুরো সফরেই ব্যর্থতা ছিল সঙ্গী। অতিবড় বাংলাদেশ ভক্তও অকপটে স্বীকার করেছেন, আগের যে কোনবারের চেয়ে এবার নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশের পারফরমেন্স খুবই হতাশাজনক।
বিশেষ করে ফিল্ডিং, ক্যাচিং আর ব্যাটিংয়ের অবস্থা ছিল চরম খারাপ। যা অন্তঃপ্রাণ ভক্তও চরম হতাশ। আর সমালোচকদের কথা, এবার নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ষোলকলা পূর্ণ করেছে বাংলাদেশ। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং-ক্যাচিংয়ের করুণ দশা। ব্যক্তিগত পর্যায়েও প্রাপ্তি-অর্জন শূন্য। প্রশংসা করার মত কোন পারফরমেন্স নেই। ৬ ম্যাচে সাকুল্যে চারটি ফিফটি; তামিম (১০৮ বলে ৭৮) ও মিঠুন (৫৭ বলে ৭৩), ক্রাইস্টচার্চে এক ম্যাচে ওয়ানডেতে জোড়া হাফ সেঞ্চুরি। এছাড়া মাহমুদউল্লাহ তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে (৭৩ বলে ৭৬)। আর টি-টোয়েন্টি সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে নেপিয়ারে সৌম্য সরকারের ২৭ বলে ৫১ রান।
একজন বোলার কোন ম্যাচে ৪-৫ উইকেট শিকার বহুদুরে, ৩ উইকেটই পেয়েছেন মোটে একবার। সেটা রুবেল হোসেনের; ওয়েলিংটনে শেষ ওয়ানডেতে। তাও ৭০ রান দিয়ে। আর বাকিরা নিজেদের হারিয়ে খুঁজেছেন। ফিল্ডিং ও ক্যাচিংয়ের অবস্থা এতটাই খারাপ যে চোখে দেখেও বিশ্বাস করা কঠিন। দিন শেষে মাঠে খেলেছেন ক্রিকেটাররা, ব্যর্থতার বড় দায় অবশ্যই তাদের কাঁধেই বর্তায়। এ ব্যর্থতার দায় অবশ্যই ক্রিকেটারদের। তারা মুখে বলেছেন অনেক কথা। কিন্তু জায়গামত তার বাস্তবরূপ দিতে পারেননি। একজন ক্রিকেটারের মধ্যেও দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ চোখে পড়েনি। কাউকে দেখে মনে হয়নি যে দল জেতাতে মাঠে নেমেছেন।
যে যার মত, লক্ষ্যহীন ক্রিকেট। দেখে মনে হয়েছে যে যেনতেন ভাবে খেলা শেষ হলেই বাঁচি। কাজেই খারাপ খেলার দায় ক্রিকেটারদের। তাদের কোনই অজুহাত নেই। করোনা, কোয়ারেন্টাইন আর আনুসাঙ্গিক প্রতিবন্ধকাতার মাঝেও প্র্যাকটিস করার পর্যাপ্ত সময় মিলেছে। নিউজিল্যান্ডে গিয়ে সেখানকার পরিবেশ-প্রতিবেশের সাথে মানিয়ে নেয়ার যথেষ্ঠ সময়ই মিলেছে।
কিন্তু পারফরমেন্সের গ্রাফ একধাপও ওপরে ওঠেনি। যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থেকেছে। বরং দিনকে দিন নীচে নেমেছে। কে যে কী করতে চেয়েছেন? তাও বোধকরি বলতে পারবেন না। যেমন আজকের ম্যাচের অধিনায়ক লিটন দাসের আউটের বর্ননাই হতে পারে ছন্নছাড়া, দায়িত্ব-কর্তব্যহীন আর বেপরোয়া উইলোবাজির চরম দৃষ্টান্ত।
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ইনজুরির কারণে অনুপস্থিতিতে আজকের ক্যাপ্টেন লিটন। তিনি ওপেন না করে নামলেন ওয়ান ডাউন। কিন্তু উইকেটে গিয়ে প্রথম বলেই সাজঘরে ফিরে আসলেন। প্রথম বলে আউট হতেই পারেন। অনেক বড় বড় ব্যাটসম্যানও হন। সেটা ভাল, সমীহ জাগানো কিংবা আনপ্লেয়েবল বল হলে মানা যেত। কিন্তু তার কিছুই ছিল না। আজ অকল্যান্ডে বাংলাদেশ লিটন দাস বোল্ড আউট হলেন উইকেটে গিয়ে একটা স্ট্যাম্প সোজা ১৩০ কিলোমিটারের বেশি গতির বলে স্কুপ করতে গিয়ে! তা কি মানা যায়?
এছাড়া প্রতি ম্যাচে গড়পড়তা তিন থেকে চারটি ক্যাচ হয়েছে হাতছাড়া। বিশেষ করে হাই ক্যাচ ধরতে রাজ্যের সমস্যা হয়েছে প্রায় সবার। মনে হয়েছে তারা বুঝি হাই ক্যাচ ধরতে পারেন না। জানেনও না। বোলাররা শুরুতে লাইন ও লেন্থ ঠাউরে উঠতে সময় নিলেও ধীরে ধীরে নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশন বুঝে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ব্যাটিং আর ক্যাচিং ছিল যাচ্ছেতাই রকমের খারাপ।
ক্রিকেটারদের এমন শ্রীহীন পারফরমেন্সে জেগেছে প্রশ্ন, আচ্ছা এই যে দলের ক্রিকেটারদের পারফরমেন্স, সেই দলে সাত থেকে আটজন ভীনদেশী কোচিং স্টাফ রেখে লাভ কী? তাদের পেছনে তো লাখ লাখ ডলার গুনতে হচ্ছে বিসিবিকে। যার ফল শূন্য। হেড কোচ রাসেল ডোমিঙ্গোর পারফরমেন্স আর তার ক্রিকেট বোধ-বুদ্ধি নিয়ে জেগেছে বিরাট প্রশ্ন। তিনি না পারছেন দলটাকে ভাল কৌশল শেখাতে, না পারছেন উজ্জীবিত করতে। দল সাজানো, কৌশল নির্ধারণ, ছক কষা, গেম প্ল্যানের কোথাও এতটুকু মুন্সিয়ানার পরিচয় রাখতে পারেননি এ দক্ষিণ আফ্রিকান।
বরং তার অসংলগ্ন কথা-বার্তা ও অদুরদর্শী সিদ্ধান্ত দেখে রীতিমত হতাশ সমর্থকরা। আজ ১ এপ্রিল অকল্যান্ডে খেলার শুরুর আগে অন্তত তিন ঘণ্টা বৃষ্টি হয়েছে। যতই উইকেট কভারে ঢাকা থাক, এমন বৃষ্টি ভেজা আবহাওয়া ও ময়েশ্চারযুক্ত পিচে তিন তিনজন দ্রুত গতির বোলার থাকার পরও কোচ বাংলাদেশের বোলিং শুরু করালেন স্পিন দিয়ে। বাঁ-হাতি নাসুম বোলিং শুরু করে বেদম মার খেলেন।
ফিল্ডিং কোচ রায়ান কুক কী শেখাচ্ছেন? তার অধীনে ফিল্ডিংয়ের মান দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে, দলের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য রিয়াদ একা নন , সৌম্য, সর্বকনিষ্ঠ সদস্য শরিফুল-আফিফরাও প্রতিনিয়ত ক্যাচ ফেলেছেন। এতটা খারাপ ফিল্ডিং আর দুর্বল ক্যাচিং চোখে পড়েনি আগে। তাই অনেক ভক্ত ও সমর্থকের প্রশ্ন, এমন নিকৃষ্ট ব্যাটিং আর যাচ্ছেতাই ক্যাচিংই যদি হয় সঙ্গী, তাহলে কেন সাত-আটজন ভিনদেশি কোচের পিছনে বছরে লাখ লাখ ডলার খরচ করা হচ্ছে? এরচেয়ে খারাপ পারফরমেন্স আর কিইবা হতে পারে?
এমন খারাপ পারফরমেন্স যেখানে সঙ্গী, সেখানে বিদেশী হেড কোচ, ব্যাটিং কোচ, পেস বোলিং-স্পিন বোলিং কোচ, ফিল্ডিং কোচ, ট্রেনার, ফিজিও আর কম্পিউটার অ্যানালিস্ট রাখার দরকারই বা কি? এরচেয়ে বড়জোর এক থেকে দুজন ভিনদেশি কোচের সাথে দেশীয় কোচদের সুযোগ দেয়া যেতে পারে। তাদের কোচিংয়ে খুব ভাল কিছু না হোক এরচেয়ে খারাপ নিশ্চয়ই হবে না ?