আনাচে-কানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সরকারি অনুমোদন ছাড়াই অধিকাংশ স্কুল-কলেজ চলছে পাড়া-মহল্লার অলিগলি ও প্রধান সড়কের পাশের ভবনে। প্লে-গ্রুপ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর (এইচএসসি) পর্যন্ত পাঠদান করা হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানে। স্বল্প জায়গায় গড়ে ওঠা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন থেকে পড়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
গত মঙ্গলবার (২৬ জুলাই) দুপুর ২টার দিকে মোহাম্মদপুরের এসএফএক্স গ্রিনহেরাল্ড স্কুলের ছাদ থেকে পড়ে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। মো. ইশরাক মঞ্জুর (১৭) নামে ওই শিক্ষার্থী ওই বিদ্যালয়ের ‘এ’ লেভেলের ছাত্র ছিল।
ইশরাক মঞ্জুরের বাবা মো. মঞ্জুরুল হাসান বলেন, আমার দুই ছেলের মধ্যে ইশরাক মঞ্জুর বড়। সে এ লেভেলের ছাত্র ছিল। একটু রাগী ও চুপচাপ স্বভাবের। প্রয়োজন ছাড়া খুব বেশি কথা বলতো না। তবে ছাত্র হিসেবে বেশ ভালো ছিল। পড়ালেখা নিয়ে তার মা তাকে মাঝে মধ্যে একটু জোরাজুরি করতো। এছাড়া অন্য কোনো সমস্যা ছিল না।
তবে ইশরাক মঞ্জুরের মৃত্যুর বিষয়ে গ্রিনহেরাল্ড স্কুলের কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শহরের অলিগলি, পাড়া-মহল্লায়, প্রধান সড়কের ওপর বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধিকাংশেরই নেই কোনো অনুমোদন। শিক্ষার পরিবেশ, ভালো মানের শিক্ষক ছাড়াই চলছে এসব প্রতিষ্ঠান। এলাকার গৃহিণী ও শিক্ষার্থীদের দিয়ে চলছে পাঠদান }। নামমাত্র বেতনে তারা সেখানে শিক্ষকতা করেন। এর বাইরে শিক্ষার্থীদের কোচিং করিয়ে বাড়তি আয় করেন।
দেখা যায়, অনুমোদনহীন এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্ধকার রুমে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। দিনেও সূর্যের আলো পৌঁছায় না এসব শ্রেণিকক্ষে। তার ওপর স্কুল কর্তৃপক্ষ বাড়তি আয় করতে শিক্ষার্থীদের নিম্নমানের প্রকাশনীর মানহীন বই কিনতে বাধ্য করে। এসব পাঠ্যবইয়ের কোনো গুরুত্ব না থাকলেও জোর করে সেগুলো পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে।
যুগের পর যুগ অনুমোদনহীন এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চললেও কেউ তদারকি করতে আসেনি। তবে নিজেদের অনুমোদন না থাকায় এসব স্কুল-কলেজগুলো অন্য কোনো অনুমোদিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন করিয়ে পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেয়।
রাজধানীর মিরপুরের মণিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের বালিকা শাখা ৬০ ফিট রোডের পাশে গড়ে উঠেছে। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রভাতী শাখায় প্রাথমিক পর্যায়ে ও দিবা শাখায় উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ক্লাস চলে। ওই এলাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়কে স্কুল গড়ে ওঠায় প্রতিদিন স্কুল শুরুর আগে ও ছুটির পর সেখানে তীব্র যানজট তৈরি হয়। ফলে স্কুলে আসা-যাওয়ার সময় প্রতিদিন নানা সমস্যায় পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের। ব্যস্ততম সড়কের পাশে স্কুলটি গড়ে ওঠায় ঝুঁকি নিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মণিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. ফরহাদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, সবাইকেই তো ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন চলতে হচ্ছে। আমাদের জায়গা সংকটের কারণে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য আলাদা রাস্তা করা সম্ভব হচ্ছে না, অভিভাবকদের জন্য ছাউনি করা যাচ্ছে না। সে কারণে কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের যাতায়াত করতে হচ্ছে।
অন্যদিকে রাজধানীর অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অলিগলির ফ্ল্যাট বাসা বা নিচতলায় অন্ধকারবদ্ধ স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে। বহুতল এসব ভবনের অনেকগুলোর ছাদের রেলিং পর্যন্ত নেই। খেলার স্থান না থাকায় শিক্ষার্থীরা সেসব ভবনের ছাদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খেলাধুলা করছে। এতে ঘটছে হতাহতের ঘটনা।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের আদাবরে অনুমোদন ছাড়া গড়ে তোলা হয়েছে ঢাকা স্কয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। ফকরুল হোসেন সবুজ নামে এক ব্যক্তি এটির প্রতিষ্ঠাতা দাবি করেন। অন্ধকার জরাজীর্ণ একটি পুরোনো ফ্ল্যাট বাড়িতে স্কুলটি গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে প্লে-গ্রুপ থেকে এসএসসি পর্যন্ত পড়ানো হয়। খেলার মাঠ না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষার্থীরা বাড়ির ছাদে খেলাধুলা করে।
জানতে চাইলে ফকরুল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, অনুমোদনের জন্য অনেক আগে আবেদন করেছি। ফ্ল্যাট বাড়িতে স্কুল করেছি বলে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। পার্শ্ববর্তী এ ধরনের কোনো স্কুলের অনুমোদন নেই। আমার স্কুলে প্লে-গ্রুপ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত চার শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। কয়েকজন শিক্ষার্থী ও পার্শ্ববর্তী কয়েকজন শিক্ষিত গৃহিণীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ভালোই চলছে।
এই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী রূপা জাগো নিউজকে বলে, ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে এ স্কুলে পড়ছি। স্কুলের কাছে বাসা হওয়ায় আম্মু এখানে ভর্তি করিয়েছে। ক্লাসে অনেক অন্ধকার। খেলার জায়গা নেই। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার জায়গা নেই। স্যার-ম্যাডাম পড়ানোর সময় সবাই হইচই করে বলে ঠিকমতো পড়া বুঝতে পারি না। মাঝে মধ্যে ছাদে উঠে খেলাধুলা করি। ছাদের রেলিং ছোট বলে ওখানে খেলতেও ভয় লাগে। সে কারণে নিয়মিত স্কুলে আসতে ইচ্ছা করে না।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, শহরের আনাচে-কানাচে অননুমোদিত অনেক স্কুল গড়ে উঠেছে। এসব স্কুলের পাশে বসবাস করা অনেকেই তাদের সন্তানদের সেখানে পড়াচ্ছেন। অনুমোদন না থাকলেও এসব স্কুল হরহামেশা চলছে, কোনোভাবেই বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। বদ্ধ এবং সংকীর্ণ স্থানে গড়ে ওঠা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা নেই। শুধু বাণিজ্যিক কারণে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে।
অধ্যাপক শাহেদুল খবির আরও বলেন, এদের রোধ করতে আইন না থাকায় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে শিক্ষা আইনে এসব স্কুলের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অনুমোদন ছাড়া কোনো ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যাবে না। এ আইন বাস্তবায়ন হলে অনুমোদন ছাড়া কেউ আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারবে না।
বর্তমানে যেসব প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোকে তাদের পার্শ্ববর্তী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হবে বলে তিনি জানান।