গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেড় বছরেরও বেশি সময় আগে গণতান্ত্রিক যাত্রার অবসান ঘটে মিয়ানমারে। এরপর থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা চলছে। গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন চালাচ্ছে দেশটির জান্তা সরকার।
আর এর পাশাপাশি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে প্রায়ই বিমান হামলা চালিয়ে থাকে সামরিক ওই সরকার। আর এসব হামলা করা হয় মূলত রাশিয়ার তৈরি যুদ্ধবিমান দিয়ে। শনিবার (৩০ জুলাই) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা চালাতে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে রাশিয়ার তৈরি ইয়াক-১৩০ মডেলের যুদ্ধবিমান ব্যবহার করার অভিযোগ আনা হয়েছে। রুশ নির্মিত এই যুদ্ধবিমানের স্থল হামলার সক্ষমতা রয়েছে।
লন্ডন-ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ‘মিয়ানমার উইটনেস’ সম্প্রতি এক রিপোর্টে এই তথ্য জানিয়েছে। মানবাধিকার এই সংগঠনটি মিয়ানমারে অধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ সংগ্রহ করার পাশাপাশি সেগুলো যাচাই এবং উপস্থাপন করে থাকে।
লন্ডন-ভিত্তিক এই সংগঠনটি বলছে, বিল্ট-আপ (আবদ্ধ) এলাকায় বেসামরিক মানুষের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের অনির্দেশিত রকেট ও ২৩ মিমি কামান ব্যবহার করার তথ্য তারা যাচাই করতে সক্ষম হয়েছে।
গত শুক্রবার প্রকাশিত নিজেদের ওই রিপোর্টে মানবাধিকার এই সংগঠনটি বলছে, ‘গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকার বারবার ইয়াক-১৩০ মডেলের যুদ্ধবিমান ব্যবহার হামলা চালানোর বিষয়টি যাচাই করে নিশ্চিত হয়েছে মিয়ানমার উইটনেস। তদন্তের সময় মিয়ানমারের জনবহুল ও বেসামরিক এলাকায় ইয়াক-১৩০-এর ব্যবহার করার বিষয়টি উঠে এসেছে।’
রাশিয়ার তৈরি ইয়াক-১৩০ মডেলের অত্যাধুনিক এই যুদ্ধবিমানের ডকুমেন্টেড গ্রাউন্ড অ্যাটাক ক্ষমতা রয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর মধ্যে গত মাসে ফেসবুকে শেয়ার করা ভিডিওতে দেখা গেছে, অন্তত একটি ইয়াক-১৩০ আকাশে উড়ে যাচ্ছে এবং মাটিতে লক্ষ্যবস্তুর দিকে আনগাইডেড রকেট নিক্ষেপ করছে।
এছাড়া দ্বিতীয় আরেকটি ভিডিওতে কমপক্ষে একটি ইয়াক-১৩০ মডেলের যুদ্ধবিমানকে পারফর্ম করতে এবং প্রায় ১৮টি রকেট নিক্ষেপ করতে দেখা যায়।
বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে এই আক্রমণগুলো মিয়ানমারের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় কারেন প্রদেশের মিয়াওয়াদ্দি শহরের দক্ষিণে হয়েছিল বলে জানা গেছে। ওই এলাকায় জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো দীর্ঘদিন ধরে স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই করছে এবং ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রতিষ্ঠিত বেসামরিক মিলিশিয়াদের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা প্রদান করছে।
মিয়ানমার উইটনেস ওই দু’টি ভিডিওর জিওলোকেটিং (ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রক্রিয়াকৃত ডিজিটাল তথ্যের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা ডিভাইসের ভৌগলিক অবস্থান শনাক্ত করা) করেছে। সংগঠনটি বলছে, এই ভিডিওগুলো থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্ত থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে ধারণ করা হয়েছে।
লন্ডন-ভিত্তিক এই মানবাধিকার সংগঠনটি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে হওয়া একটি বিমান হামলার ঘটনাও যাচাই করেছে। সেসময় মিানমারের পূর্বাঞ্চলে থাই সীমান্তের কাছে কায়াহ প্রদেশের লোইকাওয়ের পশ্চিম এলাকায় অভিযানে অংশ নেওয়া একটি ইয়াক-১৩০ যুদ্ধবিমান শনাক্ত করা হয়েছিল।
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে দেশটির সামরিক বাহিনী। বন্দি করা হয় গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সু চি ও তার দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) বিভিন্ন স্তরের কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে।
এরপর থেকেই দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা চলছে। সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং অত্যন্ত কঠোরভাবে গণতন্ত্রপন্থিদের বিক্ষোভে দমন-পীড়ন চালিয়েছেন। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারে জান্তা সরকারের দমন-পীড়নে ২ হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়েছেন। এছাড়া প্রায় ৭ লাখ মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
আলজাজিরা বলছে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে অস্ত্র ও সরঞ্জামের গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী দেশ রাশিয়া। এছাড়া মিন অং হ্লাইং চলতি মাসের শুরুতে এ বিষয়ে আরও চুক্তির জন্য মস্কো সফরে যান।
২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে মিয়ানমারে ১২টি যুদ্ধবিমান সরবরাহ করেছিল রাশিয়া। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটি সেসময় শাসন করছিল বেসামরিক প্রশাসন। তবে গত বছরের ডিসেম্বরে মিয়ানমারের মিকটিলা বিমান ঘাঁটিতে আরও ছয়টি যুদ্ধবিমান উন্মোচন করা হয় বলে জানিয়েছে মিয়ানমার উইটনেস।