এক ছেলে, এক মেয়ে ও স্বামী-স্ত্রী। চার সদস্যের পরিবারে স্বামী ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সংসার ও ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে হিমশিম খেতেন স্বামী। একটু সুখে থাকতে ঋণ করেন অনেক টাকা। কাজ করে ঋণের টাকা পরিশোধ করার চেষ্টাও করছিলেন। কিন্তু পাওনাদাররা একমুঠে সব টাকা নিতে চাপ দিতে থাকেন।
পাওনাদারদের কঠিন শর্ত, হয় টাকা দাও, না হয় কিডনি দাও। তখনই পড়েন বেকায়দায়। কিডনি চক্রের সদস্যদের প্রলোভনে পড়ে টাকার বিনিময়ে একটি কিডনি বিক্রি করে দেন। কিন্তু এ টাকা দিয়ে ঋণ তো মেটেইনি। উল্টো স্ত্রীর কিডনিও বিক্রি করতে হয়েছে।
জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার মাত্রাই উলিপুর গ্রামের আজাদুল ইসলাম ও তার স্ত্রী আজেমা খাতুনের জীবনে ঘটেছে এমন করুণ ঘটনা। প্রলুব্ধ হয়ে ও ফাঁদে পড়ে তারা শুধু শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গই হারাননি। অস্ত্রোপচারের আগে যে টাকায় চুক্তি হয়েছে, পরে তার অর্ধেকও পাননি তারা। আজাদ সাত লাখ টাকায় কিডনি বিক্রির পর পেয়েছেন দেড় লাখ টাকা, আর আজেমা পাঁচ লাখ টাকায় চুক্তির পর পেয়েছেন দুই লাখ টাকা। তার মানে কিডনি চক্রের সদস্যরা তাদের সঙ্গে করেছে বড় প্রতারণা।
আজাদের দাবি, চুক্তির পুরো টাকা পেলে ঋণ শোধ করে সুখের সংসার করতে পারতেন। তখন আর স্ত্রীর কিডনিটা বিক্রি করতে হতো না। কিন্তু কিডনি কেনাবেচা চক্রের সদস্যরা তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। আজও ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারেননি, তাই ঋণের বোঝা ঘাড়ে থেকেই গেল। তাই অভাবে কিডনি বিক্রি করেও এখন কাঁদছেন তারা।
সর্বস্ব হারিয়ে আজাদ এখন মাত্রাই বৈরাগীহাট বাজারে একটি চায়ের দোকান দিয়েছেন। সেই দোকান থেকে যা আয় হয়, তা দিয়েই কোনোরকম চলে অভাবের সংসার।
তবে এবার আজাদুল-আজেমার পাশে দাঁড়াচ্ছে জয়পুরহাট জেলা পুলিশ। আগামী ২২ জুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের উপস্থিতিতে আজেমাকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা হবে। এদিন আজাদ-আজেমা ছাড়াও কালাই উপজেলার ১৪ জন অসহায়, দুস্থ ও অসুস্থ কিডনি প্রদানকারীকে আর্থিক সহযোগিতা করা হবে।
এ বিষয়ে আজেমা খাতুন বলেন, আমরা এখনো ঋণগ্রস্ত থেকে গেলাম। অভাবের সংসার। তাই ছোট একটি চায়ের দোকান করে খাই। অভাব আর ঋণের তাড়নায় আমরা কিডনি দিয়েছি। ঋণের চাপে পড়ে জীবনে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অথচ ঋণের জালেই আটকা আছি, ঋণমুক্ত হইনি। চুক্তি অনুযায়ী টাকা হাতে পাইনি। এখন পুলিশ আমাদের সাহায্য করতে চেয়েছে। এই সাহায্যে আমরা চলতে পারব।
শারীরিক জটিলতার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন কোনো ভারী কাজ করতে পারি না। খুব কষ্টের ভেতরে আছি। আমরা যে ভুল করেছি, এই ভুল যেন আর কেউ না করে।
কিডনি বিক্রেতা আজাদুল ইসলাম বলেন, ঋণের টাকা শোধ করতে না পেরে কিডনি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু কিডনি দিয়েও সময়মতো টাকা পাইনি। এখন ছোট চায়ের দোকান করে খাই। কোনো ভারী কাজ করতে পারি না। এখন খুব কষ্টের ভেতরে আছি। না বুঝে আমরা যে ভুল করেছি, কেউ যেন এই ভুল না করে।
শুধু তারাই নন, কালাই উপজেলায় কিডনি চক্রের খপ্পরে পড়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন আরও অনেক নারী-পুরুষ। তেমন একজন তাহাজুল ইসলাম। অভাবের সংসারে স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। শেষে সুদে ঋণ নেন। কিন্তু সময়মতো পরিশোধ করতে পারেননি। তাই বাধ্য হয়ে হারাতে হয়েছে মানবদেহের অতিগুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
তাহাজুলের স্ত্রী বলেন, আমি একটি অসুখে পড়ি। সেই অসুখের টাকা জোগাড় করতে আমার স্বামী হিমশিম খেয়ে ওঠেন। তখন আমাদের অনেক টাকা ঋণ হয়। এই ঋণে পড়ে তা শোধ করতে না পেরে স্বামী বাধ্য হয়ে একটি কিডনি বিক্রি করে দেয়।
তাহাজুল বলেন, আমি মানুষের কাছ থেকে অনেক টাকা সুদ ও ধার করে নিয়েছিলাম। এসব টাকায় স্ত্রীর অপারেশন করি। পরে ধারদেনা বেশি হয়ে যায় এবং তা আমি দিতে পারি না। কাজকর্মও তেমন করতে পারি না। যে টাকা পাই তা দিয়ে সংসার চালাব, নাকি দেনা দেব? এ জন্য আমি স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় চলে গেছিলাম।
তিনি আরও বলেন, ঢাকায় চার বছর গার্মেন্টসে চাকরি করেছি, রিকশা চালাইছি। তারপরও দেনা শোধ করতে পারিনি। তখন আমি জানতে পারলাম অনেক মানুষ তাদের কিডনি দিয়ে দেনা শোধ করেছে। তাই আমিও একটা কিডনি দিয়ে দেনা শোধ করি। কিন্তু এখনো কিছু মানুষ টাকা পাবে। খুব কষ্টের মধ্য দিয়ে আছি।
যেভাবে পড়েন চক্রের ফাঁদে
চক্রের ফাঁদে পড়া প্রসঙ্গে তাহাজুল বলেন, প্রথমে আমাকে কিছু টাকা হাওলাত (ধার) দেয় তারা। আবার এই টাকা পরে সুদ হয়ে যায়। যখন টাকা পরিশোধ করতে পারি না, তখন যাদের থেকে টাকা নিই, তারা বলে কিডনি বিক্রি করো। তাদের চাপে বাধ্য হই।
আরেক কিডনি বিক্রেতা মাত্রাই গ্রামের আবু বক্কর বর্তমানে অটোরিকশা চালান। এই টাকা দিয়ে কোনো রকমে চলে তার সংসার। তিনিও চক্রের ফাঁদে পড়ে সরল বিশ্বাসে নিয়েছিলেন ঋণ। শেষে সুদসহ তা হয়ে ওঠে গলার ফাঁদ। খোয়াতে হয়েছে কিডনি।
আবু বক্কর বলেন, প্রথমে তারা আমাকে কিছু টাকা হাওলাত দেয়। পরে সুদ হয়ে যায়। যখন টাকা পরিশোধ করতে পারি না, তখন যাদের থেকে টাকা নিই, তারা বলে কিডনি বিক্রি কর। আমি বলি, কিডনি বিক্রি করলে কী পাব? তারা বলে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পাবি। প্রলোভনে রাজি হয়ে যাই। কিন্তু কিডনি বিক্রি করার পর দেড়-দুই লাখ টাকা হাতে দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। পুরো টাকা দাবি করলেও তারা দেয় না। এই সামান্য টাকা দিয়েও আমাদের কিছু হয় না। তাদের বিরুদ্ধে গেলে তারা আমাদের দালাল বানায়, আমাদের বিরুদ্ধেই মামলা হয়। এখন পুলিশ আমাকে সাহায্য করার কথা বলেছে। সাহায্য পেলে কিছুটা চলতে পারব।
জয়পুরহাট জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মাছুম আহাম্মদ ভূঁঞা বলেন, আগামী ২২ জুন জেলা পুলিশের উদ্যোগে জঙ্গি, সন্ত্রাস ও মাদকবিরোধী সমাবেশ করা হচ্ছে। সেখানে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে কিডনি কেনাবেচা চক্রের প্রতারণার শিকার এমন অসহায়, দুস্থ ও অসুস্থ ১৫ জন কিডনি প্রদানকারীকে আর্থিক সহযোগিতা করা হবে।
তিনি আরও বলেন, এখানে আমাদের দুটি উদ্দেশ্য আছে। প্রথমত, অসহায় ও দুস্থদের পাশে দাঁড়ানো। দ্বিতীয়ত, যারা কিডনি পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত, তাদের ম্যাসেজ দেওয়া যে এসবের সঙ্গে জড়িত থাকলে আইনের আওতায় আনা হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের নাম কিডনি। স্ত্রী ও পুরুষ দুজনের শরীরে সাধারণত দুটি কিডনি থাকে। কিডনি প্রত্যেক ব্যক্তির আহারের ধরন ও মাত্রা প্রতিদিন পরিবর্তিত রাখে। আহারের মধ্যে বৈচিত্র্যের কারণে শরীরে জল, অম্ল ও ক্ষারের মাত্রা নিরন্তর পরিবর্তিত হয়। আহারের পাচনপ্রক্রিয়ার সময় অনেক অনাবশ্যক পদার্থ শরীরে উৎপন্ন হয়। শরীরে জল, অম্ল বা ক্ষারের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের মাত্রার ভারসাম্য নষ্ট না হলে তা মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর বা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। কিডনি শরীর থেকে অনাবশ্যক দ্রব্য বা পদার্থ মূত্র হিসেবে শরীর থেকে বের করে রক্তের পরিশোধন করে এবং শরীরে ক্ষার ও অম্লের ভারসাম্য বজায় রাখে। এভাবে কিডনি শরীরকে স্বচ্ছ ও সুস্থ রাখে।
জয়পুরহাট জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. ওয়াজেদ আলী বলেন, কিডনি মানবদেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কিডনি দেহের এসব অনাবশ্যক দ্রব্য শরীর থেকে বের করে শরীরকে সুস্থ রাখে। কেউ কিডনি বিক্রি করলে শারীরিক জটিল সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনকি মৃত্যুর কারণও হতে পারে।
কিডনি বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেনাবেচা আইন
দেশে কিডনির গুরুত্ব ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেনাবেচা আইন রয়েছে। মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন-১৯৯৯-এর ৯ ধারায় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেনাবেচা বা বিনিময়ে কোনো প্রকার সুবিধা লাভ এবং সেই উদ্দেশ্যে কোনো প্রকার বিজ্ঞাপন প্রদান বা অন্য কোনোভাবে প্রচারণা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
একই আইনের ১০(১) ধারা অনুযায়ী কেউ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেনাবেচা বা সহায়তা করলে সর্বনিম্ন তিন বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। শাস্তির বিধান অক্ষুণ্ন রেখে ২০০৯ সালে ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনেও সংযোজন করা হয়েছে।