দীর্ঘ আঠারো মাস বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ সময়ে অন্যান্য স্কুল কলেজের মতো বন্ধ ছিল শিশুদের পদচারণায় মুখর কিন্ডারগার্টেনগুলো। গত বছরের সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয় সরকার। এরপর ক্ষতি কাটানোর চেষ্টায় নামেন কিন্ডারগার্টেন মালিকরা।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেখা দেয় করোনার ওমিক্রন ধরনের সংক্রমণ। এতে আবারও বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সংক্রমণ কমায় এক মাস পর আবার খুলে যায়। এরপর থেকে কিন্ডারগার্টেন মালিকরা আবারও ক্ষতি কাটানোর চেষ্টায় নামেন। তবে করোনার ধাক্কা সামলে এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি রাজধানীর অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেন।
কিন্ডারগার্টেন মালিকরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতিতে সরকার বা শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা তাদের পাশে থাকেননি। আয় না হলেও সেই সময়ে ব্যয় কমেনি। অনেকে জমিজমা বিক্রি করে স্কুল টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছেন। কমেছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। কমেছে পরিসর। অনেক মালিক খরচ চালাতে না পেরে বন্ধ করে দিয়েছেন- এমন খবরও গণমাধ্যমে এসেছে। বেতন পাননি অনেক শিক্ষকই।
মোহাম্মদপুরের বছিলা প্রিপারেটরি স্কুলের পরিচালক শেখ এ রহমানের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তিনি বলেন, করোনাকালে সরকার বা শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা আমাদের পাশে ছিলেন না। আমার স্কুলে প্রতি মাসে ১ লাখ ৫ হাজার টাকা খরচ হয়। ১৮ মাসে খরচ প্রায় ১৯ লাখ টাকা। খরচের পুরোটাই জমি বিক্রি করে আর টাকা ধার করে দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, জমি বিক্রি ও ধার-দেনা করে কোনোমতে স্কুলটি টিকিয়ে রাখতে হয়েছে। বর্তমানেও স্কুলের অবস্থা খুব ভালো বলা যাবে না। যে পরিমাণ শিক্ষার্থী আছে, তাতে শুধুমাত্র ভর্তুকির ওপর স্কুল দাঁড়িয়ে আছে। প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা পেনাল্টি (জরিমানা) দিতে হচ্ছে।
শেখ এ রহমান বলেন, আমার ক্ষতি পূরণীয় না। পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে স্কুল টিকিয়ে রেখেছি। ১০ লাখ টাকার জমি বিক্রি করেছি। যা আমি আর কখনোই ফেরত পাব না। আমার প্রতিষ্ঠানে অপেক্ষাকৃত নিম্ন আয়ের শিক্ষার্থীরা পড়ে। নামমাত্র টিউশন ফি দেয় তারা, যা দিয়ে আমাদের চলতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। আমার যা আয় হচ্ছে তাতে নিজের পকেটে কিছু ঢুকছে না। প্রতি মাসে শুধু জরিমানাই গুনতে হচ্ছে।
শুধু শেখ এ রহমান নন, এমন অবস্থা রাজধানী ঢাকার বেশিরভাগ কিন্ডারগার্টেন মালিকের। রামপুরার রেইনবো কিন্ডারগার্টেনের মালিক শাহেদুল হাসান বলেন, করোনার ধাক্কা আমরা এখনও সামলে উঠতে পারিনি। নতুন করে স্কুল খুললে যে অবস্থা, আমাদের অবস্থা তেমনই। ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কমে তিনভাগের একভাগ হয়ে গেছে। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি ঘুরে দাঁড়ানোর।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা সাধারণত ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে ভর্তি হয়। কিন্তু সেসময় প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। ক্লাস শুরু হয়েছে মার্চে। করোনার সময়ে বাসা ভাড়া, অন্যান্য বিল কমানো হয়নি। সামনের বছর দেখি যদি কিছু ছাত্র বাড়ে। আর নইলে এভাবে চালানো দায় হয়ে যাবে। স্কুলের ভাড়া দিয়ে আর কুলাতে পারছি না।
টিকাটুলির শিশুকুঞ্জ কিন্ডারগার্টেনের মালিক মো. আব্দুর রশীদ বলেন, আমাদের বিপদ কাটেনি। যে বাড়িতে স্কুল ছিল, করোনার মধ্যে তারা সেটি ফেরত নিয়েছে। এখন আরেকটি বাসায় ছোট পরিসরে স্কুল পরিচালনা করছি। শিক্ষার্থীর সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। আগের ক্ষতি তো আছেই। এখন বাসা ভাড়া দিয়ে কোনোরকম চালাচ্ছি।
তিনি বলেন, করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের ক্লাস হয়েছে কম। ফলে বেতন দিতে চান না অভিভাবকরা। তাই ক্ষতি পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। শিক্ষকদের সবাইকে বেতনের পুরো অংশ দেওয়া সম্ভব হয়নি। অল্প অল্প করে কিছু দিয়েছি।
আরও কয়েকটি কিন্ডারগার্টেন মালিকের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, অনেক কিন্ডারগার্টেন বন্ধ করে দিতে হয়েছে। কারণ, ভাড়া ফ্ল্যাটে কিন্ডারগার্টেন চালানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাদের নিজস্ব ভবন আছে, তারাই চালাচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি করোনার ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।
তবে এ অবস্থা থেকে কীভাবে দ্রুত বেরিয়ে আসা যায়, সেই চেষ্টাই করছেন সবাই। তবে রাজধানীর বনানী, বসুন্ধরা, বারিধারা, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার কিন্ডারগার্টেনগুলো করোনার সময় অনলাইনে নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা নিয়েছে। এসবের কারণে ফি আদায়ে তাদের কোনো সমস্যা হয়নি। শিক্ষকদের বেতনও দেওয়া হয়েছে ঠিকঠাক।
করোনার পর কিন্ডারগার্টেনগুলোর পরিস্থিতির বিষয়ে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের সহকারী শিক্ষা সম্পাদক মো. মোশারেফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেড় বছর স্কুল বন্ধ থাকলেও দুই বছর ফি আদায় হয়নি। করোনার পর স্কুল শুরু করার পর সব শিক্ষার্থীকে পাওয়া যায়নি। ফলে অনাদায়ের ক্ষতি পোষানো সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, ফির ভয়ে অনেক শিক্ষার্থী নতুন করে ভর্তিও হয়নি। তাই এত অল্প সময়ে এই ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। ক্ষতি কাটাতে অনেক সময় লাগবে। ১৮ মাসের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে অন্তত ১০ বছর সময় লাগবে। তবে রাজধানীর অভিজাত এলাকার স্কুলগুলো নামকাওয়াস্তে শিট-পরীক্ষার কথা বলে ফি আদায় করতে পেরেছে।
মো. মোশারেফ হোসেন বলেন, ঢাকা জেলার মধ্যে ৮ হাজারের মতো কিন্ডারগার্টেন রয়েছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র ঢাকা সিটিতে রয়েছে ৬ হাজার। আর সারাদেশে সব মিলিয়ে ৪০ হাজারের মতো। কিন্ডারগার্টেনে ভর্তুকির জন্য আমরা বিভিন্ন সময়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীসহ বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেছি। এর ভিত্তিতে গাজীপুর, রাজশাহী, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম সিটির একটি অংশসহ কয়েকটি জেলায় মাত্র দুই থেকে তিন হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়েছে। যা আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
এ বিষয়ে জানতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মো. জাকির হোসেনের মোবাইল ফোনে কল করা হলেও নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। পরে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।