বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী নিয়ে ভারতীয় পরিচালক শ্যাম বেনেগাল নির্মাণ করেছেন ‘মুজিব’ সিনেমা। কান চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৫তম আসরের তৃতীয় দিন ছবিটির ট্রেলার প্রকাশ পায়। ট্রেলারটি প্রক্যাশ্যে আসার পর থেকেই বাংলাদেশের দর্শক হতাশা প্রকাশ করছেন। চলছে সমালোচনাও।
এ নিয়ে পরিচালক শ্যাম বেনেগাল, নায়ক আরিফিন শুভ, অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশার পর এবার মুখ খুললেন ‘মুজিব’ ছবির বাংলাদেশ অংশের লাইন প্রডিউসার মোহাম্মাদ হোসেন জেমী। তিনি রয়েছেন বর্তমানে আমেরিকায়। সেখান থেকেই সমালোচনার আঁচ লেগেছে তার গায়ে।
তারই জবাব দিলেন ফেসবুকে। তিনি দীর্ঘ এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘অনেক পুরনো কথা এটি। বইয়ের প্রচ্ছদ দেখে গোটা বইকে বিচার করা ঠিক নয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জীবনী ভিত্তিক চলচ্চিত্র মুজিব, একটি জাতির রূপকার এর ট্রেলার সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। বিশিষ্টজনরা এই সমালোচকদের দুই ভাগে ভাগ করেছেন। এক ভাগ করছেন গঠনমূলক সমালোচনা। অন্য ভাগ করছেন সমালোচনার জন্য সমালোচনা। যেখানে সৃষ্টি আছে সেখানে সমালোচনা থাকবেই। গঠনমূলক সমালোচনা যে কোনো সৃষ্টির জন্য ইতিবাচক। যারা শুধু সমালোচনা করার জন্য সমালোচনা করেন তাদের উচিত হবে মুক্তির পরে ছবিটি সম্পূর্ণ দেখা।
যার জীবনী নিয়ে চলচ্চিত্র তার ভূমিকায় অভিনয় করা শিল্পীকে হুবহু যে তারই মত দেখতে হবে এমনটি ঠিক নয়। গান্ধী চলচ্চিত্রে গান্ধীর চরিত্রে রূপদানকারী বেন কিংসলে প্রায় গান্ধীর মতোই দেখতে ছিলেন। এই বিষয়টি ব্যতিক্রম একটি উদাহরণ। অনেক চলচ্চিত্র আছে, যার জীবনী নিয়ে চলচ্চিত্র তার সাথে রূপদানকারী শিল্পীর চেহারা এবং শারীরিক গঠনের মিল নেই। যেমন আমেরিকার নেইশন অফ ইসলামের নেতা ম্যালকম এক্স এর জীবনী ভিত্তিক চলচ্চিত্রে ম্যালকম এর চরিত্রে রূপদানকারী ডেনজেল ওয়াশিংটন এর সাথে ম্যালকম এক্স এর তেমন কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।
Invictus ছবিতে ম্যান্ডেলার চরিত্রে রূপদানকারী মরগান ফ্রিম্যান এর সাথে ম্যান্ডেলার চেহারা এবং শারীরিক গঠনের অনেক পার্থক্য রয়েছে। বিখ্যাত জ্যাজ সিঙ্গার রে’ চার্লস এর বায়োপিকে রে চার্লসের চেহারার সাথে অভিনয়শিল্পী জেমি ফক্স এর তেমন কোনো মিল নেই। বলিউড অভিনেতা সঞ্জয় দত্তের জীবনী ভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘সঞ্জু’তে সঞ্জয়ের বাবা সুনীল দত্তের চরিত্রে রূপদানকারী অভিনয় শিল্পী পরেশ রাওয়ালের বিন্দুমাত্র মিল নেই। এভাবে আরো অনেক উদাহরন দেওয়া যায়। এখানে চেহারার মিল এবং শারীরিক গঠন মুখ্য নয়। যার জীবন নিয়ে চলচ্চিত্র তার প্রকৃত জীবন ইতিহাস, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি অভ্যাসগুলো বিশ্বাসযোগ্য করে গড়ে তোলা হচ্ছে সেই চরিত্রে রূপদানকারী শিল্পীর মূল কাজ।
বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে রূপদানকারী আরিফিন শুভ’র সাথে বঙ্গবন্ধুর কতটা মিল অমিল সেই নিয়ে সমালোচকরা ব্যস্ত হয়ে গেছেন। এখানে মূলত দেখা উচিত আরিফিন শুভ তার অভিনয় শৈলী দিয়ে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রকে কতটা সার্থক রূপ দিতে পেরেছেন।
ট্রেলারের অনেক কারিগরি অংশের সমালোচনাও ভিত্তিহীন এবং সিনেমা না বোঝার অপরিপক্কতা। ট্রেলারে অডিও এবং ভিডিও প্রিল্যাব এবং ওভারল্যাপ করা হয়। সময়কে সংকুচিত করার জন্য এক জায়গার অডিও অন্য জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হয়। এতে করে দেখা এবং শোনার পরিধি বেড়ে যায় সংকুচিত সময়ের মধ্যে। মুজিব চলচ্চিত্রের ট্রেলারে এমনটি হয়েছে বেশ কয়েকবার। এই কৌশলটি শুধু মাত্রই ট্রেলার এর জন্য। এটা বুঝতে না পেরে অনেক সমালোচক ছবি এবং শব্দের মিল না পেয়ে মনে করছে ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। অপেক্ষা করুন ছবিটি মুক্তি পর্যন্ত। তারপর ছবিটিকে মন দিয়ে দেখুন।
একটি গড় হিসেবে দেখা গেছে, হলিউডের চলচ্চিত্রে যদি প্রতি মিনিটে $1,000 এর উৎপাদন বাজেট থাকে, তাহলে সম্ভবত VFX এর জন্য প্রতি মিনিটে $2000-$5000 খরচ করা হয়। খুব চোখ ধাঁধানো এবং বিশ্বাসযোগ্য ভিএফএক্স এ ভরপুর চলচ্চিত্রে মোট প্রোডাকশন খরচের দুই থেকে পাঁচ গুণ বেশি খরচ করা হয় শুধুমাত্র ভিএফএক্সের জন্য। এই হিসাবের নিরিখে মুজিব চলচ্চিত্রের মোট বাজেট এবং তার জন্য ভিএফএক্সের খরচের উপর নির্ভর করছে গুণগত মান।
তাই সবার জন্য আহ্বান থাকবে চলচ্চিত্রটি মুক্তির পরে এক বা একাধিকবার দেখে চলচ্চিত্রটির গঠনমূলক সমালোচনা করার জন্য। আমি বিশ্বাস করি, দর্শকদের অধিকার আছে যে কোন চলচ্চিত্রের মুক্ত সমালোচনা করার। এই ছবিটির ক্যামেরার পেছনের আমি একজন অংশীজন ছিলাম। চিত্রনাট্য নিয়ে বিশেষজ্ঞদের গবেষণা এবং প্রতি মুহূর্তে যতটা নির্ভুল সম্ভব বাস্তবতাকে তুলে ধরার কোন ঘাটতি এখানে ছিল না।
গান্ধী ছবিতেও অনেক ডিটেইলে ভুল রয়ে গেছে। যেগুলো ইতিহাস বিকৃতির পর্যায়ে পড়ে। এছাড়াও ছবির কন্টিনিউটিতে আছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভুল। ১৯৪৭ সনে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির সময় পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলনের দৃশ্যে পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত ব্যাকগ্রাউন্ডে সংযোজিত হয়েছিল। অথচ সেই সংগীতটি তৈরি হয়েছিল ১৯৪৯ সালে। এরপরও সব ভুল ছাপিয়ে গান্ধী চলচ্চিত্রকে একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে ধরা হয়। মুজিব চলচ্চিত্রে কিছু ভুল থাকতেই পারে। আমার বিশ্বাস সেগুলো অতিক্রম করে বাঙালির চেতনা এবং মননে বঙ্গবন্ধুর প্রতি যে গভীর শ্রদ্ধা আছে সেটা সমুন্নত থাকবে বায়োপিক দেখার পরেও।
আশা করছি মুজিব, একটি জাতির রূপকার চলচ্চিত্রটি সবার মনকে ছুঁয়ে যাবে। সেই দিনের অপেক্ষায় আছি। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।’ এদিকে ‘মুজিব’ ছবিতে শিল্পী সংগ্রহের দায়িত্ব পাওয়া একটি প্রতিষ্ঠান অভিযোগ এনেছেন লাইন প্রডিউসার ৩০ শতাংশ কমিশনের বিনিময়ে এই ছবিতে অনেক শিল্পীকে অভিনয়ের সুযোগ দিয়েছেন। এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি মোহাম্মদ হোসেন জেমীর।