ইউক্রেন যুদ্ধ সারা বিশ্বের পণ্য বাজারে বড় প্রভাব ফেলেছে। বাণিজ্যের বৈশ্বিক গতিপথই পালটে দিচ্ছে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে উৎপাদন, বাণিজ্য এবং ভোগ ব্যয়ে বাড়ছে। পণ্য মূল্যবৃদ্ধির এই প্রভাব ২০২৪ সাল পর্যন্ত থাকতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক’প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত দুই বছরে জ্বালানি তেলের মূল্য যে হারে বেড়েছে সেটি ১৯৯৩ সালের সংকটের পর আর দেখা যায়নি। ইউক্রেন এবং রাশিয়া বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্য সরবরাহকারী বড় দেশ। চলমান এই যুদ্ধের প্রভাবে প্রাকৃতিক গ্যাস সংকটে সারের দাম বেড়েছে। সারের মূল্যবৃদ্ধির এই হার ২০০৮ সালের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অুনযায়ী চলতি বছর জ্বালানির মূল্য গড়ে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি থাকতে পারে। সেইসঙ্গে কৃষিপণ্য এবং ধাতব পণ্যের মূল্য গড়ে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। আগামী দুই বছর মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা থাকতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদি ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয়, সেইসঙ্গে রাশিয়ার ওপর বিধিনিষেধ বজায় থাকে সেক্ষেত্রে নিত্যপণ্যের মূল্য আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
যুদ্ধের প্রভাবে তেল উত্তোলন বাধাগ্রস্ত হবে। ধারণা করা হচ্ছে এ বছর অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেল প্রতি গড়ে ১০০ ডলার থাকতে পারে, যা ২০১৩ সালের পর সর্বোচ্চ। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ বছর তেলের দাম গড়ে ৪০ শতাংশ বেশি থাকবে। তবে ২০২৩ সালে এই দর গড়ে ৯২ ডলারে নেমে আসতে পারে। ইউরোপের বাজারে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম গত বছরের তুলনায় এ বছর দ্বিগুণ থাকতে পারে। কয়লার দাম গত বছরের তুলনায় ৮০ শতাংশ বেশি থকবে। প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লার এই দর অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চ। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের প্রসপেক্টস গ্রুপের পরিচালক আয়হান কোস উল্লেখ করেছেন, উচ্চ দ্রব্যমূল্য ইতিমধ্যে বিশ্ব জুড়ে মূল্যস্ফীতির চাপকে বাড়িয়ে তুলেছে। খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ফলে উল্লেখযোগ্য মানবিক ও অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হচ্ছে এবং এটি সম্ভবত দারিদ্র্য হ্রাসের অগ্রগতি থামিয়ে দিচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এ বছর গমের দাম গড়ে ৪০ শতাংশ বেশি থাকবে। গমের এই মূল্যবৃদ্ধি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এর প্রভাবে উন্নয়নশীল দেশ যারা গম আমদানি করে তারা বেশ চাপে থাকবে। বিশেষ করে যারা ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে গম আমদানি করছে। এ বছর ধাতব পণ্যের মূল্য গড়ে ১৬ শতাংশ বেশি থাকবে। ২০২৩ সালের আগে এই দর কমার সম্ভাবনা নেই। তবে আগামী বছরও উচ্চ মূল্য থাকতে পারে। এবারের প্রতিবেদনে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব কীভাবে বিশ্ববাজারকে প্রভাবিত করছে সেটি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যুদ্ধের প্রভাব দীর্ঘায়িত হতে পারে।
বিশেষ করে পূর্ববর্তী অর্থনৈতিক সংকটগুলোর চেয়ে এবারের সংকটগুলো আরো দীর্ঘায়িত হবে। কারণ জীবাশ্ম জ্বালানির যে সংকট তার প্রভাবে শুধু পরিবহন খরচই বাড়াচ্ছে না, সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষিপণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে। সরবরাহ সংকটে দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে বাণিজ্যের খরচও বেড়ে যাচ্ছে যা দীর্ঘ মেয়াদে মূল্যস্ফীতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, কিছু দেশ এখন জীবাশ্ম জ্বালানি কয়লার জন্য তুলনামূলক দূরবর্তী স্থান থেকে আমদানি করতে চাইবে। আবার কিছু প্রধান কয়লা আমদানিকারক দেশ বড় রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে চাহিদা কমিয়ে রাশিয়া থেকে আমদানি বাড়াতে পারে। এই ধরনের আমদানির পরিবর্তন খরচ আরো বাড়িয়ে দেবে। প্রতিবেদনটি নীতিনির্ধারকদের তাদের নাগরিকদের এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির ক্ষতি কমানোর জন্য অবিলম্বে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে। খাদ্য এবং জ্বালানি ভর্তুকির পরিবর্তে সামাজিক সুরক্ষাবলয় বাড়াতে পরামর্শ দিয়েছে। যেমন—নগদ সহায়তা কার্যক্রম, স্কুল ফিডিং কর্মসূচি ইত্যাদি।