আটকদের অধিকাংশই বাংলাদেশের নাগরিক। তারা জারিখ উপকূল থেকে নৌকাযোগে ইউরোপের উদ্দেশ্যে রওয়ানার প্রস্তুতিতে ছিলেন। ত্রিপোলীর বাংলাদেশ দূতাবাস মানবজমিনকে জানিয়েছে, শনিবার সাগর পাড় থেকে আটক অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি থাকায় তাৎক্ষণিক দু’জন কর্মকর্তাকে ডিটেনশন সেন্টার ফলোআপের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা আইওএম এবং স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছেন। আটক অভিবাসীদের একটি অংশকে ত্রিপোলী নিয়ে আসা হয়েছে জানিয়ে দূতাবাসের এক কর্মকর্তা বলেন, লিবিয়ান পুলিশ যে তথ্য শেয়ার করেছে তাতে মোট ৫৪১ জন আটকের কথা বলা হয়েছে। যার মধ্যে ৫ শতাধিক বাংলাদেশি রয়েছেন মর্মে প্রাথমিক ধারণা দেয়া হয়েছে। ওই টিম রোববার ২৪০ জনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে বলে রাতে মানবজমিনকে জানান রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল শামীম উজ-জামান। দূতাবাস টিম তাদের নাগরিকত্ব যাচাই-বাছাই শুরু করেছে জানিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, এ সংক্রান্ত রিপোর্ট আসার পরই নিশ্চিত হওয়া যাবে তাতে আসলে কতোজন বাংলাদেশি রয়েছেন।
এ কারণে এখনই তার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেন ওই তথ্যদাতা। জানান, ২০১৬ সালের পর একদিনে উপকূল থেকে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি আটকের ঘটনা এটাই প্রথম। ওই বছরে ৬ শতাধিক অভিবাসীকে সাগর থেকে উদ্ধার এবং ২০২০ সালে বন্দিশালায় গুলি করে ২৬ অভিবাসন প্রত্যাশীকে হত্যার পর লিবিয়া রুটে দালালদের তৎপরতায় ভাটা পড়েছিল। তাছাড়া করোনার ধাক্কাও ছিল। কিন্তু এখন করোনার প্রকোপ কমে আসা এবং সাগর শান্ত থাকায় অবৈধ অভিবাসন প্রত্যাশীর ভিড় বাড়ছে। সেই বিবেচনায় সাগরে মনিটরিংও বাড়িয়েছে লিবিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষ। অবৈধ অভিবাসন বিরোধী ডিভাইসের ব্যবহারে ছোট ছোট গ্রুপও ধরা পড়ছে। বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে, শনিবার আটক অভিবাসীদের প্রথমে জেলা শহর মিসরাতার একটি ডিটেনশন সেন্টারে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে গাদাগাদি হওয়ায় একটি অংশকে তৎক্ষণাৎ রাজধানী ত্রিপোলীর বিমানবন্দর সড়কের একটি কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়েছে। তাদের খাদ্য, পানীয় এবং অন্য জরুরি সহায়তা প্রদান করেছে পুলিশ। নাগরিকত্ব যাচাই শেষে তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের মার্চে লিবিয়ার পশ্চিম উপকূলে চারটি নৌকা থেকে ৬০০ শরণার্থীকে উদ্ধার করা হয়েছিল। সেই দলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি থাকলেও বেশির ভাগই ছিলেন আফ্রিকার সাব সাহারান অঞ্চলের।
বিভিন্ন দেশ থেকে উন্নত জীবনের আশায় শরণার্থীরা পাড়ি জমাচ্ছেন ইউরোপে। তাদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে ইউরোপের দেশগুলো। লিবিয়ার পাচারকারীদের মাধ্যমে শরণার্থীরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্কতা জারি করে বলেছে, লিবিয়া ইউরোপে শরণার্থী সংকটের অন্যতম উৎ?স হয়ে দাঁড়াচ্ছে। লিবিয়া কোস্টগার্ডের বরাতে সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, এক সময় ত্রিপোলীর পশ্চিম উপকূল ব্যবহার করে অবৈধ অভিবাসীরা ইউরোপের উদ্দেশ্যে সাগর পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করতো। ওই উপকূল থেকে ২০১৬-২০ সাল অবধি বড় বড় উদ্ধার অভিযান হয়েছে। সেই রুটে পুলিশ ও কোস্টগার্ডের নজরদারি বাড়ার প্রেক্ষিতে এখন রাজধানী থেকে ২৫০ কিলোমিটার পূর্বের মিসরাতা রুটকে পাচারকারীরা নিরাপদ ভাবতে শুরু করেছে। কিন্তু না, ওই রুটও যে নজরদারির বাইরে নয়, সেটা প্রথম হয়েছে শনিবারের ঝটিকা অভিযানে। রিপোর্ট বলছে, করোনার প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করায় দীর্ঘ সময় অবৈধ অভিবাসীদের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত ছিল লিবিয়ান কোস্টগার্ড এবং পুলিশ।
এই সময়ে তারা নিরিবিলি পাচার রুটে ম্যাপিং করেছে। যেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যরা প্রযুক্তিগত, কারিগরি এবং সরঞ্জামাদি সহায়তা দিয়েছে। সে মতে, এখন লিবিয়ান পুলিশ ও কোস্টগার্ড অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সমৃদ্ধ। তাদের হাতে রয়েছে নজরদারির অত্যাধুনিক প্রযুক্তিও। ফলে অভিযান পরিচালনা থেকে শুরু করে আটক-উদ্ধার এবং ডিটেনশন এবং প্রত্যাবাসনে নতুনত্ব আনা হয়েছে। মিসরাতায় অভিযান হলেও দ্রুততার সঙ্গে আটককৃতদের একটি অংশকে ত্রিপোলীর তারিক আল মাতার ডিটেনশন সেন্টারে পৌঁছানো এবং তাদের প্রতি মানবিক ব্যবহার সেই নতুনত্বের উদাহরণ বলে বর্ণনা করেন ওই সেন্টারের পরিচালক আবদুস সালাম। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম বলছে, চলতি ২০২২ সালের প্রথম ৩ মাসে ডজনখানেক অপারেশনে ভূমধ্যসাগর থেকে ৪ হাজার অবৈধ অভিবাসীকে উদ্ধার এবং আটক করেছে। যার মধ্যে ৩৮১ জন নারী এবং ১৬৯ শিশু রয়েছেন।
আইওএম-এর রিপোর্ট মতে, ২০২১ সালে ৩২ হাজার ৪ শ’ ২৫ অবৈধ অভিবাসীকে লিবিয়া উপকূল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, যাদের একমাত্র টার্গেট ছিল ইউরোপে পাড়ি জমানো। ওই বছরে ভূমধ্যসাগরের লিবিয়া রুট থেকেই ৬৬২ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। আর ওই রুটে মিসিং বা সলিল সমাধি ঘটেছে ৮৯১ জনের। উল্লেখ্য, যুদ্ধ বিধ্বস্ত লিবিয়ায় দীর্ঘ ৪ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশিদের ভ্রমণ নিষিদ্ধ ছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা ২০১৬ সালের ওই ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ হয়েছিল। কিন্তু আদালত মন্ত্রণালয়ের নোটিশের পক্ষেই রায় দেন। ফলে এটি এতদিন বহাল ছিল। চলতি বছরের সূচনাতে জনস্বার্থ বিবেচনায় ওই ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। এরপর থেকে দেশটিতে কর্মসংস্থান ভিসা নিয়ে অনেকেই যেতে পারছেন। দূতাবাস সূত্র বলছে, ওই বাংলাদেশিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ লিবিয়াতে কর্মসংস্থান না খুঁজে বরং সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টাই করছেন। আর এ কারণে গত ৩ মাসে ৫ শতাধিক বাংলাদেশিকে সাগর থেকে উদ্ধার করে আইওএম’র স্পন্সর টিকিটে দেশে ফেরাতে হয়েছে।