স্বাধীনতার পর থেকে কখনোই ঘোষিত বাজেটের শতভাগ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। বরং প্রতি বছরই বেড়েছে বাজেটের আকার। নতুন প্রকল্প গ্রহণ, নতুন উৎসাহ নিয়ে ব্যয় করার একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা প্রতি বছরই জাতির সামনে তুলে ধরা হয়। কিন্তু বছর শেষে তা সংশোধন করা হয়। সংশোধিত সেই বাজেটও বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। চলতি বছরের চিত্রও ব্যতিক্রম নয়। বরং এবারে বাস্তবায়ন হার আরো কম। যদিও বাস্তবতাও এবারে ভিন্ন। করোনা, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ব জুড়ে যে অর্থনৈতিক অস্থিরতা চলছে তার মধ্যে ধনী দেশগুলোর অর্থনীতিও টলটলায়মান। এমন পরিস্থিতিতে আগামী বছরের বাজেটও আকারে বড় হয়ে ৬ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকার মতো দাঁড়াচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট ব্যয় চূড়ান্ত করা হয়েছে। চলতি বছরের বাজেট ব্যয় ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। সর্বশেষ তথ্যমতে, অর্থবছরের ৯ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৪৫ শতাংশ। বাকি তিন মাসে অবশিষ্ট ব্যয় সম্ভব নয়। কোভিড মহামারি বাজেট বাস্তবায়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তবে এটিও ঠিক যে, স্বাধীনতার পর কখনোই সংশোধিত বাজেটও বাস্তবায়ন করা যায়নি।
বাজেট বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ হিসেবে বিভিন্ন সময়ে দক্ষতা ও সমন্বয়হীনতার অভাবকে দায়ী করা হলেও বিগত কয়েক বছর ধরে এ দুটো খাতে বেশ কাজ হয়েছে। তথাপি বাস্তবায়ন হয়নি শতভাগ। কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ ব্যয় করতে না পারলে অন্য প্রকল্পে টাকা স্থানান্তরের নিয়মও করা হয়েছে। কিন্তু বছর শেষে এ কাজেও ততটা সুফল মেলে না। বরং বছরের শেষ দিকে এসে টাকা ফেরত দিতেও অনীহা কোনো কোনো মন্ত্রণালয় ও বিভাগের। তাতে পরবর্তী বছরের বরাদ্দ কমে যেতে পারে—তাই মার্চ মাস পেরুলেই অনুমোদন নিয়ে কোনো রকম একটি ব্যয় কাঠামো তৈরি করা হয়। বাস্তবে কাজ হয় না।
সূত্রমতে, এই ধরনের ফাঁকফোকর থাকার পরও বাজেটের বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। গত এক দশকে ২০১০-১১ অর্থবছরেই বাজেটের বাস্তবায়ন তুলনামূলক বেড়েছে। কিন্তু শতভাগ হয়নি। সরকারি হিসাবেই গত ১০ বছরের সংশোধিত বাজেট বাস্তবায়নের হার গড়ে ৭০ শতাংশের কম হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১০-১১ অর্থবছরে ১ লাখ ৩২ হাজার ১৭০ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়। অর্থবছর শেষে বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে ৯৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। বাজেটের খরচের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ১ লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে ব্যয় করা অর্থের পরিমাণ ১ লাখ ৫২ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা। বাস্তবায়নের হার ৯৩ দশমিক ১৮ শতাংশ।
২০১২-১৩ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ১ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে ব্যয় হয় ১ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাজেট বাস্তবায়নের হার ৯০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো বাজেটের আকার ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা হয়। বছর শেষে মোট বাজেটের মধ্যে ব্যয় হয় ১ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। বাজেট বাস্তবায়নের পরিমাণ ৮৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাজেট ঘোষণা করা হয় ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। বাস্তবায়ন করা হয় ২ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে বাজেট বাস্তবায়নের হার ৮১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়। পরে তা কমিয়ে ২ লাখ ৬৪ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করলেও শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়েছে ২ লাখ ৩১ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। বাজেট বাস্তবায়নের হার ৭৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাজেট আকার ছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। বছর শেষে বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে ৭৬ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট আকার ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে ২৮ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা কাটছাঁট করা হয়।
বছর শেষে বাজেট বাস্তবায়নের হার দাঁড়ায় ৭০ শতাংশের কিছু বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেটের আকার ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। সংশোধিত বাজেটে এর আকার দাঁড়ায় ৪ লাখ ৪২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা। প্রকৃত বাস্তবায়ন হয় ৩ লাখ ৯১ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। বাস্তবায়নের হার ৮৯ শতাংশের কম। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট পেশ করা হয়েছিল গত ১৩ জুন ২০১৯ তারিখে। ২১ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা কমিয়ে সংশোধিত বাজেট ঠিক করা হয় ৫ লাখ ১ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা। করোনার প্রভাবে বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে ৭০ শতাংশের কম। ২০২০-২১ বছরের মূল বাজেট ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার। বাজেট সংশোধনের পরও ৭০ শতাংশ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
করোনার ঢেউয়ে সংশোধিত ব্যয় কাঠামোর বাস্তবায়নও হচ্ছে না। উপরন্তু, গত কয়েক বছর ধরে প্রত্যাশিত হারে আয়ও বাড়ছে না। রাজস্ব খাতে নানান বিশৃঙ্খলার কারণে আয় কমেছে। যদিও পরোক্ষ করের চাপে পড়েছে সাধারণ ভোক্তারা। অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশের বাজেটের আকার প্রথমবারের মতো লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। গত ১০ বছরে নানা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ফলে, বাজেটের আকার বেড়ে যায়। তবে শতভাগ বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনিক দক্ষতা এবং সচেতনতা বাড়াতে হবে।