কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষার আন্দোলনকারী সৈয়দা রত্না ও তার কিশোর ছেলেকে ১৩ ঘণ্টা থানায় আটকে রাখার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, কোনো আইনসিদ্ধ অভিযোগ ছাড়াই দীর্ঘ ১৩ ঘণ্টার বেশি সময় আটক রাখা দেশের সংবিধান ও আইনের ন্যক্কারজনক লঙ্ঘন ও বেআইনি।
কলাবাগান থানা পুলিশের এই আচরণ নাগরিকদের বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক চর্চার অধিকার ও মানবাধিকারের পরিপন্থি বলে বলেও দাবি তাদের। পাশাপাশি পুলিশি হয়রানির তদন্তও দাবি করেছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। এদিকে এই জায়গায় মাঠ থাকবে না থানা হবে, সেটা আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে-জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘রবিবার দিনভর প্রতিবাদের মুখে মাঝরাতে থানা কর্তৃপক্ষ সৈয়দা রত্না ও তার ছেলেকে ছেড়ে দিলেও মাঠ রক্ষায় তিনি আর আন্দোলন করবেন না বলে বেআইনি মুচলেকা নেওয়া হয়েছে। আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, কলাবাগান থানা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সৈয়দা রত্না ও তার নাবালক পুত্রকে কোনো রকম আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে আটকে রাখে। এটা আইনের ন্যক্কারজনক লঙ্ঘন ও বেআইনি। এরকম অবৈধ আটক ও মুচলেকা গ্রহণের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি আমরা এবং এজন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী প্রধান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, কোনো অভিযোগ ছাড়া সম্পূর্ণ বেআইনি মুচলেকা নিয়ে তাদেরকে ছাড়া হয়েছে। এরকম মুচলেকা নিয়ে ছাড়ার আইনি কোনো সুযোগ নেই। এটা শুধু ইচ্ছাকৃত নয়, পরিকল্পিতও। এটা করা হয়েছে শুধু এলাকার মানুষজনকে ভয় দেখানোর জন্য। পুলিশের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমরা কেউ নিরাপদ বোধ করছি না। এটা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে ওদের। পকেটের মধ্যে ইয়াবা ঢুকিয়ে দেওয়া, যখন-তখন তুলে নিয়ে যাওয়া।’ সংবাদ সম্মেলনে অধিকারকর্মী খুশী কবির, বাপার সহসভাপতি স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন ছিলেন।
আয়োজক বাপা, বেলা ছাড়াও ছিল এলএলআরডি, ব্লাস্ট, আসক, গ্রীন ভয়েজ, আমরা করি, নাগরিক উদ্যোগ, নারীপক্ষ, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, হিউম্যান রাইটস সোসাইটি। এদিকে পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন সোমবার তেঁতুলতলা মাঠে গিয়েও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। সেখানে স্থানীয়রাও ছিলেন, যারা সেখানে শিশুদের খেলার সহান হিসেবে মাঠটি রক্ষা করার দাবি জানান। ঢাকায় শিশুদের খেলার সহানের চরম সংকটের মধ্যে কলাবাগানের মাঠটিতে কোনো ভবন না করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)।
উদ্বেগ প্রকাশ করে সোমবার এক বিবৃতিতে আইপিডি বলেছে, কলাবাগান এলাকায় জনসংখ্যা অনুপাতে আরো মাঠ প্রয়োজন। আদর্শগতভাবে নগর পরিকল্পনায় ২ হাজার থেকে ৩ হাজার মানুষের জন্য ন্যূনতম একটা খেলার মাঠ তৈরি করতে হয়, যার আয়তন ন্যূনতম এক একর (তিন বিঘা) হওয়ার কথা। আমাদের ঢাকা শহরের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি পাড়া-মহল্লায় প্রতি ১২ হাজার ৫০০ মানুষের জন্য দুই থেকে তিনটি খেলার মাঠ থাকা উচিত, যার মোট আয়তন হওয়ার কথা তিন একর। অতি ঘন এলাকা কলাবাগানে আনুমানিক ৩০ হাজারের মতো মানুষের বসবাস। প্রতি ৫ হাজার মানুষের জন্য একটি খেলার মাঠ দেওয়া হলেও এই এলাকায় ছয়টি খেলার মাঠ থাকবার কথা, আকার-আয়তনে যা ছয় থেকে ১০ একর হওয়ার কথা। তেঁতুলতলা মাঠের আয়তন এক বিঘার মতো, ফলে এটিও মানদণ্ড অনুযায়ী শিশুদের খেলার মতো পর্যাপ্ত নয়।
সোমবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমি ঘটনার যতটুকু জেনেছি, তারা (রত্না ও তার ছেলে) লাইভ ভিডিওতে এসে অনেক কিছু প্রচার করছিল। যেগুলো নাকি একটু অসঙ্গতিপূর্ণ। সেজন্য বারবার নিবৃত্ত করার পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন থামাতে পারেনি, তখন তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য থানায় নিয়েছিল এবং জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
সোমবার মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। এই মাঠ খেলার মাঠ হিসেবেই থাকবে, না সেখানে থানার জন্য ভবন করা হবে, সে বিষয়ে ‘আলোচনা করে’ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। থানার জন্য বিকল্প জায়গা খোঁজার কথা জানালেও তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, বিকল্প জায়গা না পেলে ঐ মাঠে ভবন তোলা হয়তো এড়ানো যাবে না।
তেঁতুলতলা মাঠের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমরা যে খেলাধুলা করেছি, সেই অবস্থাটা এখন আর নেই। আমরা সেজন্য কষ্টবোধ করি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। কলাবাগানের প্রসঙ্গ যখন আসছে, আমরা যা কিছুই বলি, গুরুত্বের দিক দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটা বড় দায়িত্ব থাকে। আমরা যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে ব্যর্থ হই, তাহলে সবকিছু মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে।
তিনি বলেন, ‘মেয়রকে বলেছি, সবাইকে বলেছি, বিকল্প একটা খোঁজার জন্য। যদি না হয়, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও এটা অতীব জরুরি। এটা আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।’ এদিকে এই মাঠ সংরক্ষণ করাসহ মাঠ রক্ষার আন্দোলনকর্মী সৈয়দা রত্না ও তার ছেলেকে পুলিশি হয়রানির নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করে বিবৃতি দিয়েছে সুশীল সমাজের নাগরিকেরা।
সোমবার সুশীল সমাজের দেওয়া এ সংক্রান্ত বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠায় বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা)। বিবৃতিতে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলেন, ‘আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, কলাবাগান থানা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সৈয়দা রত্না ও তার নাবালক ছেলেকে কোনো রকম আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে, কোনো আইনসিদ্ধ অভিযোগ ছাড়া দীর্ঘ ১৩ ঘণ্টারও বেশি সময় আটক রাখা দেশের সংবিধান ও আইনের ন্যক্কারজনক লঙ্ঘন ও বেআইনি।’
বিবৃতিদাতাদের মধ্যে আছেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সুলতানা কামাল, ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, ড. হামিদা হোসেন, খুশী কবির, শাহীন আনাম, মেঘনা গুহঠাকুরতা, ড. ইফতেখারুজ্জামান, রাশেদা কে চৌধুরী, শামসুল হুদা, শিরিন হক, অধ্যাপক পারভীন হাসান, ড. ইমরান রহমান, শাহ্দীন মালিক, সারা হোসেন, প্রফেসর আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক গীতিয়ারা নাসরীন, অধ্যাপক এম এম আকাশ, মির্জা তাসলিমা সুলতানা, ড. আসিফ নজরুল, মো. নূর খান লিটন, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রমুখ।
এদিকে কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এলাকাবাসী। গতকাল বেলা সাড়ে ৩টার দিকে মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধনে এ ঘোষণা দেন এলাকার বাসিন্দা স্থপতি ইকবাল হাবীব। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, খুব শিগগিরই এখান থেকে থানার ভবনের নির্মাণকাজ স্থানান্তর করা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই আশ্বাসের পরও যদি কেউ ঈদুল ফিতরের বন্ধে মাঠে কোনো সীমানা দেওয়াল নির্মাণ করতে চায়, তবে এলাকার সবাই প্রতিবাদ গড়ে তুলবে।