রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সংঘর্ষ ও দুজন নিহতের ঘটনায় জড়িত অস্ত্রধারী ছয়জনের নাম-পরিচয় নিশ্চিত হয়েছেন গোয়েন্দারা। তারা ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। এরমধ্যে নিহত নাহিদকে কুপিয়ে জখমকারী ইমনকে আটক করা হয়েছে। হেলমেট পরিহিত এ গ্রুপের সবাই ছিলেন হামলার সম্মুখভাগে। এছাড়া ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ধারালো অস্ত্র নিয়ে সরাসরি হামলায় অংশগ্রহণকারী আরও সাতজনের পরিচয় নিশ্চিতের পথে রয়েছেন তদন্তকারীরা।
তিন স্তরে অবস্থান নিয়ে হামলা পরিচালনাকারীদের সামনের সারিতে ছিলেন অস্ত্রধারীরা। সেখানে ছিল ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপের সদস্য। গোয়েন্দাদের হাতে থাকা বেশিরভাগ ফুটেজে তাদের ছবিই এসেছে। তাদের পরের স্তরেই ছিল দেশীয় অস্ত্রসহ থাকা আরেকটি দল। এ দলের ছয়জনকে শনিবার রাতে এবং রোববার সকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি ইউনিট তাদের হেফাজতে নিয়েছে। ঘটনার আদ্যোপান্ত জানতে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী চার শীর্ষ নেতাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
হেফাজতে থাকা ও জিজ্ঞাসাবাদ করা ব্যক্তিদের যাচাই-বাছাই শেষে অপরাধ প্রমাণিত না হলে ছেড়ে দেওয়া হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় সূত্রগুলো এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। মঙ্গলবার সংঘর্ষের সময় কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী নাহিদ হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একই ঘটনায় নিহত হন দোকানকর্মী মোহাম্মদ মুরসালিন। দুই হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলা দুটির তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
তাদের পাশাপাশি র্যাব ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা ঘটনার ছায়া তদন্ত করছে। তদন্তকারী সূত্রগুলো বলছে, সংঘর্ষের পর থেকেই ভিডিও ফুটেজগুলো গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করছিল তারা। নজরদারিতে রেখেছিল হামলায় অংশগ্রহণকারীদের। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নাহিদকে কোপানো ইমনসহ কয়েকজকে আটক করা হয়েছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কিছুই জানাননি তারা। আটককৃতদের নাম প্রকাশ করলে তাদের সহযোগীরা পালিয়ে যেতে পারেন-এমন আশঙ্কায় এখনই নাম প্রকাশ করতে চান না তারা।
ইতোমধ্যে সেদিনের ঘটনায় জড়িতরা গা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এজন্য তাদের কয়েকজন চুল কেটে ন্যাড়া হয়ে, দাঁড়ি রেখে, চোখে গ্লাস পরে, নিয়মিত পাঞ্জাবি পরে আত্মগোপনের চেষ্টা করছেন। আটক ইমনও গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিতে ফেসবুক আইডি ডিঅ্যাকটিভেটেড করে, মোবাইল ফোন বন্ধ রেখে বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন বলে জানান গোয়েন্দারা।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপকমিশনার (ডিসি) ফারুক হোসেন রোববার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ছয়জনের নাম-পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। ভিডিও ফুটেজ দেখে অন্যদেরও শনাক্ত করা হচ্ছে। যেহেতু ঘটনায় ছাত্রদের সম্পৃক্ততা রয়েছে, তাই তদন্তে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। যাতে নিরীহ কেউ কোনোভাবে শাস্তি না পায়। তবে হত্যায় জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
তিনি আরও জানান, নিউমার্কেটে সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে চারটি মামলা হয়। এর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার তদন্ত করছে থানা পুলিশ এবং দুটি হত্যা মামলার তদন্ত করছে ডিবি পুলিশ। হত্যা মামলা ছাড়া অন্য দুই মামলায় অভিযুক্তদের ধরতেও চলছে অভিযান। এদিকে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, ঘটনার পর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেখানে কয়েক দফায় অভিযান চালিয়েছে। শনিবার রাত ৩টার দিকে, রোববার সকালে এবং বিকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যরা পৃথক অভিযান পরিচালনা করেন।
এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ফলে অনেকেই হল ছাড়তে শুরু করেছেন। কলেজ ছাত্রলীগের শীর্ষ চার নেতাকে গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে এ আতঙ্ক আরও বেড়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ করা নেতাদের মধ্যে রয়েছেন-ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের বিলুপ্ত আহ্বায়ক কমিটির সদস্য জসীম উদ্দিন, কলেজের সুপার সিক্স গ্রুপের সদস্য এবং বিলুপ্ত আহ্বায়ক কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম তিতাস, বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সামাদ আজাদ জুলফিকার ও বিলুপ্ত কমিটির আহ্বায়ক সদস্য আসিফুজ্জামান রানা।
তাদের প্রত্যেকেই কলেজ ছাত্রলীগের শীর্ষ পদপ্রত্যাশী। রোববার সকাল থেকে নেতাকর্মীরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না বলে জানান। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওই কর্মকর্তা বলেন, জিজ্ঞাসাবাদ করা মানেই তারা অপরাধী এমন নয়। যেহেতু তারা একটি ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং তাদের অনেক অনুসারী রয়েছে সেজন্য ঘটনা তদন্তের স্বার্থে তাদেরকে ডাকা হয়েছে।
সম্পৃক্ততা না পেলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। এদিকে রাত সাড়ে ১২টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সামাদ আজাদ জুলফিকারসহ দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। জানতে চাইলে ডিবির রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এইচএম আজিমুল হক রোববার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, দুই হত্যা মামলা তদন্তে আমাদের বেশ অগ্রগতি রয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজগুলো দেখে প্রত্যেকের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে।
এছাড়া গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত আছে। অনেকের বিষয়ে অনেক ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে যাচাই-বাছাই শেষে নিশ্চিত হয়েই এ বিষয়ে চূড়ান্তভাবে বলা যাবে। এদিকে শনাক্ত হওয়া অপরাধীদের অনেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে বিভিন্ন মহল থেকে তদবিরের চেষ্টা করছেন। অনেকেই নিরপরাধ প্রমাণে ঘটনার সময় নিজের ইতিবাচক ভূমিকা তুলে ধরছেন।
কেউ কেউ আবার হত্যার ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন না তা প্রমাণ করতে চাইছেন। গণমাধ্যমে ছবি প্রকাশের পর অনেকেই ছেড়েছেন ক্যাম্পাস। কেউ কেউ প্রকাশিত ছবিকে অন্যের বলে চালানোর চেষ্টা করছেন। রোববার ঢাকা কলেজের হলের কক্ষগুলোতে গিয়ে এদের কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রগুলো বলছে, তারা চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত না হয়ে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন না। এছাড়া কোনো তদবিরেও প্রভাবিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ খুনিদের ভিডিও ও ছবি ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়ে গেছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, তারা হত্যায় জড়িতদের ধরতে বেশকিছু কৌশল অবলম্বন করছেন। এক্ষেত্রে যাদের আটক করা হয়েছে এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়েছে, তাদের সঙ্গে নিয়ে ফুটেজগুলো বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। কারণ সেখানে থাকা প্রত্যেকেই আটককৃতদের পরিচিত। এর ফলে জড়িত কারও পার পাওয়ার সুযোগ নেই। যেহেতু গ্রেফতারকৃতদের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি, তাই সহযোগীরা হয়তো ভাবতেও পারছে না তারাও আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকায়।
যে কোনো সময় সহযোগীদের বড় একটি অংশকেও গ্রেফতার করা হতে পারে। এসবের পাশাপাশি সংঘর্ষে ব্যবহৃত অস্ত্রের জোগানদাতা ও সংরক্ষণকারীদের খোঁজ করছেন তারা। এছাড়া হামলার আগে ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে কয়েক দফায় গোল হয়ে শলাপরামর্শ করা হয়। সেখানে কী কথা হয়েছে এবং কারা ছিল-তা নিয়েও চলছে পর্যালোচনা। তাছাড়া সংঘর্ষকালে পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার মামলায় গ্রেফতার বিএনপি নেতা মকবুল হোসেন সরদারকেও রিমান্ডে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
রিমান্ডের প্রথম দিনেই তার কাছ থেকেও সংঘর্ষের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের নিউমার্কেট জোনের পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শাহেনশাহ। আটক ইমন : নিউমার্কেটে সংঘর্ষকালে কুপিয়ে খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে আটক ইমন ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগ কর্মী বলে জানা গেছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ইমনসহ আরও কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রগুলো বলছে, নাহিদকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ভাইরাল হওয়া ভিডিও ও ছবিটি ইমনের। ইমন ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র। তার গ্রামের বাড়ি খুলনায়। সেদিন তিনি বাম হাতের উপরের অংশে এবং পায়ে ইটের আঘাতে আহত হন। ছবি ও ভিডিওতে দেখা গেছে, তার বাম হাত ছিল কাপড় দিয়ে বাঁধা। ইমনের সঙ্গে ভিডিওর ওই যুবকের চেহারার মিল খুঁজে পেয়েছে পুলিশ।
মামলার পর থেকে ইমনকে আর দেখা যায়নি। বন্ধ ছিল তার মোবাইল ফোন। ডিঅ্যাক্টিভ করা হয়েছে তার ফেসবুক আইডি। নাহিদকে প্রথমে যে দুজন মারধর শুরু করে তারা হলো কাইয়ুম ও সুজন ইসলাম। গোয়েন্দারা এখন পুরো ঘটনার পরম্পরা মেলানোর চেষ্টা করছেন। ঢাকা কলেজে ডিবির অভিযান : এদিকে রোববার বিকাল ৫টায় কলেজের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসের ১০১ নম্বর কক্ষে অভিযান চালায় ডিবির সদস্যরা। অভিযান শেষে দুটি মোবাইল সেট ও জহির হাসান জুয়েল নামের এক শিক্ষার্থীকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানা গেছে।
আটক জুয়েল ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের বিলুপ্ত আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী বলে জানা গেছে। তবে ডিবির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ক প্রভাষক মো. কামরুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ডিবি সদস্যরা এসেছিলেন। এ সময় দুটি মোবাইল ফোনসেট জব্দ করা হয়েছে। তবে কোনো শিক্ষার্থীকে আটক করে নেওয়ার বিষয়ে তার কাছে তথ্য নেই বলে জানান তিনি। হল প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে কিনা-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমার সঙ্গে কথা হয়নি, হয়তো প্রিন্সিপাল স্যারের সঙ্গে কথা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।