চালের মজুতের দিক থেকে স্বস্তির সময় পার করছে বাংলাদেশ। কিন্তু দামের ক্ষেত্রে অস্বস্তি কাটছে না। গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় ১১ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বেশি মজুত আছে। এর মধ্যে চাল পৌনে ১০ লাখ ও গম পৌনে এক লাখ মেট্রিক টন। শুধু তাই নয়, যে পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত থাকা নিরাপদ মনে করা হয়, তার চেয়ে এই মুহূর্তে বেশি খাদ্য সরকারের হাতে আছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাদ্য সচিব ড. নাজমানারা খানুম বুধবার বলেন, ‘করোনা মহামারি, পরিবহণ ব্যয় ও শ্রমিকের খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে খাদ্যশস্যের দাম বেড়েছে। তিনি বলেন, বিশ্বের যেখানেই যা হচ্ছে সব দেশের ব্যবসায়ীরা সেটা জানতে পারছেন। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম, বৈশ্বিক পরিস্থিতির সুযোগে আগের কেনা পণ্যের দামও নির্মমভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হয়।’
এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সরকারের দায়িত্ব কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, ‘হ্যাঁ এই জায়গায় সরকার ভূমিকা পালন করছে, তবে আরও জোরালো ভূমিকা নেওয়া দরকার। পর্যায়ক্রমে আমরা সেইদিকেই যাচ্ছি।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে নাজমানারা খানুম বলেন, ‘আমনের উৎপাদন ভালো হওয়ায় আমরা খুবই সুন্দর অবস্থানে আছি। এবার হাওড়ে বড় সমস্যা না হলে আশা করি সামনের বছরটাও ভালো যাবে।’
গত বছর চালের মজুত অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় অস্বস্তিতে পড়েছিল সরকার। এ ছাড়া ২০১৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত খাদ্যশস্য মজুত ও আমদানিতে মোটামুটি স্বস্তির ধারায় ছিল। খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে মোট খাদ্যশস্য মজুতের পরিমাণ ১৫ লাখ পাঁচ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে চাল ১৩ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন, গম এক লাখ ৬৬ হাজার মেট্রিক টন ও ধান ৭২ লাখ মেট্রিক টন।
২০২১ সালের ১৩ এপ্রিল দেশে সরকারি খাদ্য মজুতের পরিমাণ ছিল চার লাখ ৭২ হাজার মেট্রিক টন। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে দেশে খাদ্য মজুতের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৮২ হাজার মেট্রিক টন। যা গত বছরের তুলনায় পৌনে ১১ লাখ টন বেশি। এ ছাড়া ২০১৯ সালে একই সময়ে খাদ্যশস্যের মজুত ছিল ১৩ লাখ ৮২ হাজার মেট্রিক টন।
এদিকে চলতি অর্থবছরের গত নয় মাসের বেশি সময়ে মোট ৪২ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি খাতে চাল আমদানি হয়েছে ছয় লাখ ৫৩ হাজার মেট্রিক টন, বেসরকারি খাতে চাল আমদানি হয়েছে তিন লাখ ছয় হাজার মেট্রিক টন। একই সময়ে সরকারি এবং বেসরকারি খাতে গম আমাদানি হয়েছে যথাক্রমে চার লাখ ৪২ হাজার ও ২৮ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন।
দেশে উৎপাদন ও আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহের দিক থেকে এক ধরনের স্থিতিশীলতা থাকলেও চলতি বছরে দামের দিক থেকে সেটার প্রতিফলন নেই। ২০১৭ সালে হঠাৎ বন্যায় ধান উৎপাদনে বড় ক্ষতি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে চালের দাম উঠেছিল ৫০ টাকা পর্যন্ত। পরের দুই বছর ভালো ফসল হওয়ার সুবাদে সেটা কমেও গিয়েছিল। কিন্তু ২০২০ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে চালের দামের ঊর্ধ্বগতি অস্বস্তির পর্যায়ে পৌঁছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মাসিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে খুচরা পর্যায়ে দেশে চালের গড় দাম ছিল কেজিতে ৩০ টাকা ৬৯ পয়সা। ২০২০ সালে একই সময়ে সেটা এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ টাকা ৮৯ পয়সা। ২০২১ সালে প্রতি কেজি ৪৪ টাকা ৪৬ পয়সা পর্যন্ত ছিল। আর চলতি বছর ঢাকার বাজারে চালের দাম ৫০ টাকার কম-বেশি হচ্ছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) চলতি বছর বাংলাদেশে খাদ্যশস্যে উৎপাদন, চাহিদা, আমদানি ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, গত বছরের তুলনায় চলতি বছর চালের উপাদন ১ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়ে তিন কোটি ৬৩ লাখ ২০ হাজার টনে দাঁড়াতে পারে। সাবেক খাদ্য সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল বলেন, ‘গত দুই বছরে চালের দাম ৪৭ শতাংশ বেড়েছে। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। দেশে খাদ্য ও আমদানি পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে বিষয়টি খুবই বেমানান। খাদ্যশস্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে এই সমস্যা হয়েছে বলে আমি মনে করি।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চালকল মালিকদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট ও নব্য করপোরেট চাল ব্যবসায়ীরা এই ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে বলে মনে হয়। এদের মধ্যে অনেকে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ায় মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তর ঠিক ভূমিকা রাখতে পারছে কিনা সন্দেহ আছে। এছাড়া দেশে জনসংখ্যার পরিসংখ্যানগত ত্রুটির বিষয়টি নিয়ে সরকারের মন্ত্রিরাও একমত।’ এসব বিষয়ে উপযুক্ত সমাধান না আনতে পারলে এই সমস্যা থেকে বের হওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করেন তিনি।