এক অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার দুই শিল্পপতির মেয়েকে ‘বিশেষ’ সুবিধা দিয়েছেন। রিটার্নে কোটি টাকা সম্পদ দেখানো হলেও তারা আয়কর দিয়েছেন ৩ হাজার ও ৬ হাজার ৬০০ টাকা। আবার সম্পদের ওপর সারচার্জ আদায়ের বাধ্যবাধকতা থাকলেও সেটি আদায় করেননি ওই কর্মকর্তা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রতিবেদনটি এনবিআর চেয়ারম্যান, কর প্রশাসন ও মানবসম্পদ বিভাগ এবং কর অঞ্চল-১২-এর কমিশনারের কাছে পাঠানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তানজিলা গ্রুপের পরিচালক তানজিলা মুনির অর্চি (২৩) এবং ডিভাইন গ্রুপের পরিচালক সামায়া হাসান (২৬) সম্পর্কে চাচাতো বোন। জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) দুইজনেরই স্থায়ী ঠিকানা, যশোরের চৌগাছা। আর বর্তমান ঠিকানা মহাখালীর ডিওএইচএস। নিয়মানুযায়ী, স্থায়ী ঠিকানা ব্যবহার করে টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) নিলে তাদের খুলনা কর অঞ্চলের করদাতা হওয়ার কথা। আর বর্তমান ঠিকানা ব্যবহার করলে ঢাকার কর অঞ্চল-৮-এর করদাতা হওয়ার কথা। কিন্তু টিআইএন ডেটাবেজের তথ্যমতে, সামায়া মানিকগঞ্জ (কর অঞ্চল-১২, সার্কেল-২৬৩) ও অর্চি নায়ক-নায়িকাদের বিশেষায়িত সার্কেলের (সার্কেল-২৬২) করদাতা।
অর্চি ২০১৯ সালে ২৬ জুন টিআইএন নেন। এতে আয়ের উৎস হিসাবে বিবিধ মালের ব্যবসা দেখানো হয়। ওইদিনই কর অঞ্চল-১২-এর অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার মো. সামসুদ্দিন (বর্তমানে খুলনা আপিলে কর্মরত) তড়িঘড়ি করে পূর্বের রিটার্ন দিতে করদাতাকে নোটিশ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে রিটার্নে অর্চি ৪ কোটি ৮৯ লাখ টাকার নিট সম্পদ প্রদর্শন করেন। আর বার্ষিক আয় দেখান ২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা এবং আয়কর দেন ৬ হাজার ৬০০ টাকা। দুই সপ্তাহ পর ১০ জুলাই কর নির্ধারণ প্রক্রিয়া শেষ করেন।
একইভাবে এক বছর পর সামায়া ২০২০ সালের ৩ মার্চ টিআইএন নেন। সেখানেও তিনি আয়ের উৎস হিসাবে বিবিধ মালের ব্যবসা দেখান। অর্চির মতো সামায়ার ক্ষেত্রেও টিআইএন গ্রহণের দিনই সামসুদ্দিন পূর্বের ৮ বছরের রিটার্ন দিতে করদাতাকে নোটিশ দেন। রিটার্নে সামায়ার নিট সম্পদ দেখানো হয় ১৩ কোটি ১০ লাখ টাকা। বার্ষিক প্রদর্শিত আয় দেখানো হয় ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এর বিপরীতে সামায়া কর দেন ৩ হাজার টাকা। অর্থাৎ অর্চির চেয়ে সামায়ার সম্পদ বেশি হওয়া সত্ত্বেও আয় কম দেখিয়ে কম আয়কর দেওয়া হয়েছে।
দুজনই বিধিমালা অনুযায়ী সারচার্জ দেওয়ার যোগ্য হলেও কারও কাছ থেকে সারচার্জ আদায় করেননি অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার মো. সামসুদ্দিন। তাছাড়া দুজনই ২০২০-২১ করবর্ষের রিটার্ন দিয়েছেন ২৫৪ সার্কেলে (ঢাকার হাজারীবাগ)। সাধারণত, একজন ব্যক্তি যে দিন টিআইএন নেন, ওই করবর্ষ থেকেই রিটার্ন জমা দিয়ে থাকেন।
সিআইসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করদাতার প্রদর্শিত আয়ের ধরন, পরিমাণ প্রদর্শিত সম্পদের পরিমাণের সঙ্গে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। এ বিষয় যথাযথভাবে যাচাই না করেই সার্কেল কর্মকর্তা রিটার্নে প্রদর্শিত সম্পদকে পূর্বের জের হিসাবে মেনে নিয়ে অস্বাভাবিক তড়িঘড়ি করে কর নির্ধারণ সম্পন্ন করা হয়েছে, যা রাজস্ব স্বার্থপরিপন্থি ও দায়িত্বে অবহেলা এবং অপেশাদারত্বের পরিচায়ক হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
এতে আরও বলা হয়, করদাতার টিআইএন রেজিস্ট্রেশনের তারিখ, আয়কর দাখিলের তারিখ, চূড়ান্ত কর নির্ধারণের তারিখ এবং অন্য আনুষঙ্গিক প্রমাণাদির আলোকে প্রতীয়মান হয় যে, করদাতার পূর্বের রিটার্ন নেই এবং তার পূর্বের সম্পদের জের থাকারও সম্ভাবনা নেই। স্থায়ী ঠিকানা যশোর এবং বর্তমান ঠিকানা মহাখালীর ডিওএইচএস হওয়া সত্ত্বেও টিআইএনের অধিক্ষেত্র মানিকগঞ্জ (২৬৩ সার্কেল) ও ২৬২ সার্কেল কীভাবে হয়েছে তাও স্পষ্ট নয়।
চূড়ান্ত কর নির্ধারণে ত্রুটি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, কর নির্ধারণের সময় সারচার্জ বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এছাড়া করদাতার ঘোষিত বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ ও ব্যাংক জমার যথার্থতা যাচাই করতে ব্যাংক থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রাপ্ত তথ্যে, রিটার্নে দাবীকৃত বিপুল পরিমাণ হাতে নগদ ও ব্যাংক জমার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। করদাতা বয়সে নবীন। এ বয়সে রিটার্নে নগণ্য আয় দেখিয়ে এবং উত্তরাধিকার সূত্রে কোনো সম্পদ না পেয়ে কী করে এত বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করলেন তা স্পষ্ট নয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার মো. সামসুদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, দুই করদাতা যখন রিটার্ন জমা দেয়, তখন টিআইএনে আয়ের উৎস হিসাবে বিবিধ মালের ব্যবসা উল্লেখ ছিল। তারা নিজের ইচ্ছাতেই একসঙ্গে ৬ বছরের রিটার্ন জমা দিয়েছেন। সরকারের রাজস্বের রিটার্ন জমা নিয়েছে। পূর্বের জের না থাকা সত্ত্বেও এত সম্পদ দেখানোর বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়নি কেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফাইলে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে অডিট করে তা শোধরানো যেতে পারে। তাছাড়া ফাইল অনুমোদনের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল। তারাও বিষয়টি দেখেননি কেন তা বলতে পারব না। নিয়ম অনুযায়ী সারচার্জ আদায়ের বিধান থাকলেও কেন করা হয়নি-এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভুলে সারচার্জ আদায় করা হয়নি। যেহেতু আয়কর নথি রি-ওপেন করার নিয়ম আছে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ চাইলে সেটির মাধ্যমে আয়কর আদায় করতে পারে।
একাধিক কর কর্মকর্তার মতে, এ দুই তরুণীর রিটার্নে বড় ধরনের ঘাপলা থাকতে পারে। ১৩ কোটি টাকা সম্পদশালী ব্যক্তির আয় কখনোই ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা এবং কর ৩ হাজার টাকা হতে পারে না। অভিভাবকদের আয় বৈধ করার প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে তরুণীদের নামে ট্যাক্স ফাইল খোলা হয়েছে। অথবা তরুণীর প্রকৃত আয় গোপন করে কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া তাদের বিপুল পরিমাণ নগদ জমা আদৌ আছে কি না, নাকি ভবিষ্যতের অপ্রদর্শিত আয়কে বৈধ করতে আগেভাগেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সেটি খতিয়ে দেখা দরকার আছে।
সামায়া হাসানের বাবা ডিভাইন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হাসানুজ্জামান বলেন, ‘এ বিষয়ে আপনি এত ইন্টারেস্টেড (আগ্রহী) কেন? ট্যাক্স ফাঁকি দিলে সেটা এনবিআর বুঝবে, আর আমার আইনজীবী বুঝবে। আপনি কার সঙ্গে কথা বলছেন জানেন। আপনি আমার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলুন।’ এরপর আইনজীবীর নম্বর চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন। আর তানজিলা মুনির অর্চির বাবা তানজিলা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুজ্জামানের বক্তব্য জানতে তার দুটি নম্বরে যোগাযোগ করা হলে দুটি নম্বরই বন্ধ পাওয়া যায়।