বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অভাবে উদ্যোক্তারা উৎপাদন চালিয়ে যেতে হিমশিম খাচ্ছেন। কিন্তু এবার ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে তাদের ওপর চেপে বসেছে গ্যাস রেশনিং। আজ মঙ্গলবার থেকে দেশে প্রথমবারের মতো কলকারখানায় চার ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন পেট্রোবাংলা। গতকাল সোমবার পেট্রোবাংলা থেকে এসংক্রান্ত বিশেষ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। আজ থেকে আগামী ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিদিন বিকাল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকবে। এই ১৫ দিন শিল্পে নির্ধারিত সময়ে গ্যাস ব্যবহার বন্ধ রাখতে শিল্পমালিকদের ‘বিশেষভাবে অনুরোধ’ করা হয়েছে। পেট্রোবাংলার নির্দেশনা ঠিকভাবে মানা হয় কি না, তা দেখার জন্য গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোকে নিয়মিত মনিটরিং করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, এর আগে সিএনজি স্টেশন, সার কারখানা এবং দোকানপাটে গ্যাস ও বিদ্যুৎ রেশনিং করা হলেও শিল্প খাতে এই প্রথম এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলো।
কয়েক জন কারখানামালিকের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে টেক্সটাইল, গার্মেন্টস এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাত। এই খাতের কারখানাগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি সম্পর্কিত। যেমন স্পিনিং মিলগুলো সুতা করে, তা দিয়ে কাপড় তৈরি হয়, সেই কাপড় গার্মেন্টসে সেলাই করে রপ্তানি করা হয়। এ ক্ষেত্রে গ্যাসের ওপর নির্ভর করা শিল্পকারখানাগুলো বন্ধ থাকলে তার প্রভাব পড়বে গ্যাস রেশনিং প্রসঙ্গে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ আল মামুন ইত্তেফাককে বলেন, এর ফলে কিছু কিছু কারখানার উত্পাদন একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ এসব কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের প্রয়োজন পড়ে। ডায়িং কারখানাগুলোর উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, এই খাতের কারখানায় একটি বয়লার চালু করতে এক ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন হয়। এছাড়া বন্ধ করার জন্য দুই ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে।
এমন আরো অনেক কারখানা আছে, যেগুলো কয়েক মিনিটের জন্যও বন্ধ রাখা যায় না। আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, গত দুই বছর করোনার কারণে দেশীয় শিল্পমালিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। যেসব টেক্সটাইল মিল থেকে স্থানীয় বাজারে কাপড় বিক্রি করা হতো, তারা এবার আশায় বুক বেঁধে ছিলেন। সামনে পবিত্র ঈদুল আজহা। এই সময়ে মিলমালিকেরা তাদের বিক্রি হওয়া পণ্যের অর্থ হাতে পেয়ে থাকেন। এবারও সেটার ব্যাঘাত ঘটবে। তিনি বলেন, এমনিতেই এসব কারখানার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ নানা কারণে রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। গ্যাস রেশনিং চললে এসব কারখানা পথে বসবে, সর্বোপরি শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে সমস্যা হবে।
তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি মাহমুদ হাসান খান এ বিষয়ে বলেন, ‘এমনিতে আগে থেকেই আমরা রেশনিং এর মধ্যে আছি। অধিকাংশ সময় আমরা গ্যাস পাই না। সেদিক থেকে বিচার করলে রেশনিং নতুন কিছু না।’ তিনি বলেন, যেসব কারখানা গ্যাস ছাড়া একেবারেই চলে না, সেগুলোর জন্য সমস্যা হবে। তবে শিল্পমালিকেরা চার ঘণ্টা গ্যাস রেশনিংয়ে সম্মত আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, বাকি সময় যাতে কারখানাগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ থাকে, তার ব্যবস্থা করতে হবে।
এদিকে গতকাল দুপুরে রাজধানীতে বিদ্যুৎ ভবনে শিল্পমালিক ও সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, রমজানের এই সময়ে বিকাল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা ব্যাপক হারে বাড়ে। আগামী ১৫ দিন তাই এই সময়টুকু সব শিল্প শ্রেণির গ্রাহকদের গ্যাস ব্যবহার বন্ধ রাখতে পারলে ভালো হয়। প্রতিমন্ত্রী বলেন, অব্যাহত উন্নয়নের ফলে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়ছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সুষম উন্নয়নের জন্য সম্মিলিতভাবে এই চাহিদা মোকাবিলা করা এখন সময়ের দাবি। সরকার জ্বালানি সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ, বিদ্যুৎ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব এ টি এম মোস্তফা কামাল, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মোহা. সেলিম উদ্দিন, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান, পিডিবির চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান, এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন, বিটিএমএর প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী খোকন, বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, ঢাকা চেম্বারসের পরিচালক মালিক তালহা ইসমাইল বারী, পলমল গ্রুপের পক্ষে মেজর (অব.) মিজান, বিটিএমএর পরিচালক প্রকৌশলী রেজাউল করিম এবং বিজিএমইএর পরিচালক আসিফ আশরাফ। প্রসঙ্গত, দেশে এখন দৈনিক ৪৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে ৩১০ কোটি ঘনফুট।