বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। সোমবার দুদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে এই আহ্বান জানানো হয়। বৈঠকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেন ব্লিঙ্কেন। জবাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সামরিক বাহিনী থেকে জন্ম নেওয়া দলটি ছাড়া সব দল নির্বাচনে আসে। তাদের নির্বাচনে আনা একটি চ্যালেঞ্জ। তাদের ভোটে নিয়ে আসুন। বৈঠকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) জবাবদিহি নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। অপরদিকে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা কোনো সুইচ নয় যে টিপ দিলেই অন কিংবা অফ হবে। এটা প্রত্যাহার একটা প্রক্রিয়াগত বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছরপূর্তিতে স্থানীয় সময় সোমবার দুপুরে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বৈঠকে র্যাব গঠন এবং নিষেধাজ্ঞা পরবর্তী চার মাসে এ এলিট ফোর্সের কাজের অগ্রগতি তুলে ধরেন মোমেন। বৈঠক শেষে তিনি বলেন, আমি বললাম, র্যাবটা আমাদের দেশে এমন সময়ে তৈরি হয়েছিল, যখন আমাদের দেশে সন্ত্রাস, জিহাদি এগুলোর উৎপাত খুব বেশি ছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, র্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলে আমি খুশি হব বলে অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে বলেছি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তটা একটি প্রক্রিয়াগত বিষয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের কর্মকাণ্ডে জবাবদিহি প্রয়োজন বলে মনে করে। আমি বলেছি, অবশ্যই। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তার সব কটিই আমরা নিয়েছি। তখন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা লক্ষ্য করেছি গত চার মাসে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি।
সোমবার ওয়াশিংটন সময় দুপুর দেড়টার দিকে শুরু হয়ে পৌনে এক ঘণ্টার মতো চলে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক। বৈঠক শেষে হোটেলে ফিরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, ‘খুবই ভালো আলোচনা হয়েছে।’ বৈঠকে র্যাবের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টি এসেছে কিনা, তা জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টি আলোচনায় তুলেছি। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বৈঠক শুরুর আগে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্য প্রচার করেছে। এতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্ব আরও এগিয়ে নেওয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। অন্যদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশে আরও বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
র্যাবের সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য দীর্ঘ প্রক্রিয়া পার হতে হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন। বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেন, এটা ওদের প্রসেস আছে। এটা আমাদের কমপ্লিট করতে হবে। এটাতে সময় লাগবে। সুইচের মতো না যে একদিনে অন আর অফ করতে পারবে। বাংলাদেশে অনেক কিছু ‘সহজে’ করা গেলেও যুক্তরাষ্ট্রে সেভাবে করা যায় না মন্তব্য করে মোমেন বলেন, আমাদের দেশের সরকার ইয়েস বললে ইয়েস হয়ে গেল। এখানে অনেক সময় চাইলেও পারে না।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, যেমন ট্যারিফ প্রত্যাহারের জন্য ২৩টা কমিটিতে অনুমোদন লাগে। তার পর প্রেসিডেন্ট সেটার ওপর রেসপন্স দিতে পারেন। এর আগে প্রেসিডেন্ট কিছু বলতে পারেন না। আপনাকে প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশে সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে জ্বালানির বাইরে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিসহ নানা খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয়েছে। বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি আকাশপথে চলাচল, বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাঠানো, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল (আইপিএস), আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠকের শুরুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেন বলেন, “বিগত ৫০ বছরের স্মৃতি মনে করলেও, আমরা আসলে আগামী ৫০ বছরের সূচনার কথা চিন্তা করছি।” দুই দেশের মধ্যকার অংশীদারত্ব জোরদার করার বিষয়ে কাজ করার ক্ষেত্রেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় ভূমিকার প্রশংসা করেন ব্লিঙ্কেন। তিনি এও জানান যে, কোভ্যাক্সের আওতায় বাংলাদেশকে এই পর্যন্ত প্রায় ৬ কোটি ১০ লাখ ডোজ টিকা দান করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে মানবতা ও উদারতা প্রদর্শন করেছে।’ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও বাংলাদেশের অবদানের জন্য ধন্যবাদ জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন। বক্তব্য শেষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান তিনি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন তার বক্তব্যের শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে প্রায় ৬ কোটি ১০ লাখ ডোজ টিকা দান করার জন্য ধন্যবাদ জানান। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি দেশটির আচরণটিকে ‘গণহত্যা’ হিসাবে আখ্যায়িত করার জন্যও যুক্তরাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন।
যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের দুঃসময় এবং সুসময়ের বন্ধু হিসাবে উল্লেখ করে ড. মোমেন একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বিগত ৫০ বছরে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে একটি প্রাণবন্ত অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার যাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রকে এক গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসাবে উল্লেখ করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হিসাবে উল্লেখ করে ড. মোমেন বলেন যে, দেশটি বাংলাদেশে সঞ্চিত বিনিয়োগের দিক থেকেও বৃহত্তম অংশীদার। তবে সেই বিনিয়োগের বেশিরভাগই জ্বালানি খাতে হয়েছে বলে ড. মোমেন বলেন যে, এখন হয়তো অন্যান্য খাতেও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র উৎসাহী হবে।
প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সংলাপ আজ : বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সংলাপ আজ যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এতে দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা জোরদারের বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত আকসা ও জিসোমিয়া চুক্তির ব্যাপারে অগ্রগতি জানতে চাইতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। অপরদিকে, বাংলাদেশের তরফে র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দ্রুত প্রত্যাহারের অনুরোধ এবং যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধু হত্যার আসামি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত চাইতে পারে বাংলাদেশ।