ঘুস লেনদেনের অবসান এবং দুর্নীতির উৎস নির্মূলের লক্ষ্যে ‘ফাঁদ মামলা’ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে বর্তমানে এই মামলার সংখ্যা গেল বছরের তুলনায় তিনগুণ কমেছে। এতে হতাশা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ঘুসের লাগাম টানতে চাইলে ফাঁদ পেতে চুনোপুঁটি নয়, রাঘববোয়াল ধরতে হবে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে আরও দৃষ্টান্তমূলক নজির সৃষ্টি করতে হবে। অভিযোগকারীর দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে না থেকে, কোথায় ঘুস লেনদেন হচ্ছে-তা খুঁজে বের করা কমিশনের দায়িত্ব। এজন্য দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটকে আরও কার্যকর ও শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তবে কমিশনের দাবি, করোনার কারণে দীর্ঘ সময় স্বাভাবিক কার্যকম পরিচালিত হয়নি। করোনার কারণেই এই ফাঁদ মামলা কমেছে। এরপরও কমিশন ফাঁদ মামলার পাশাপাশি দুদকের হটলাইনে (১০৬) অভিযোগ প্রাপ্তি ও সফলভাবে অভিযান পরিচালনা করেছে। এসব অভিযানের মাধ্যমেও বেশকিছু দুর্নীতির ঘটনা ঘটার আগেই তা প্রতিহত হয়েছে।
জানতে চাইলে দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল অনুবিভাগ) ও সাবেক জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলাম বলেন, দেশে প্রচুর পরিমাণ ঘুসের কারবার হচ্ছে। ছোট পর্যায়ে কেরানিরাও যেমন জড়িত, বড় পর্যায়েও কর্মকর্তারা তেমন জড়িত। তবে দুদকের ফাঁদ মামলায় শুধু ছোট মাপের কর্মকর্তাদের গ্রেফতারের নজির রয়েছে। বড় কর্মকর্তাদের ফাঁদ পেতে গ্রেফতারের নজির নেই। আর বড় কর্মকর্তাদের ঘুসের লেনদেনও নিশ্চয়ই বড় হয়ে থাকে। সেজন্য যিনি বড় কর্মকর্তাদের ঘুস দিয়ে সুবিধা নিতে চান, তিনি দুদকে সেই অভিযোগ করেন না। তাই বড় কর্মকর্তাদের ও ঘুসদাতাদের হাতেনাতে ধরতে দুদকের আরও নতুন নতুন চিন্তা করতে হবে। কমিশনের গোয়েন্দা ইউনিটকে আরও কার্যকর ও শক্তিশালী করতে হবে।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুদকের ফাঁদ মামলার কার্যক্রম আরও বাড়াতে হবে। ঘুস-দুর্নীতি বন্ধ করা না গেলেও ফাঁদ মামলার মাধ্যমে তা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এক্ষেত্রে ঘুসের টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেফতারদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে দুদকে তথ্য প্রদানকারীদের সার্বিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে। এতে সাধারণ মানুষ উৎসাহী হয়ে দুদকের কাছে তথ্য দেবে।
ফাঁদ মামলার উদ্দেশ্যে : সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপিত দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০২০ ও ২০২১) বলা হয়, দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় সংস্থা দুদকের সব কাজের মূল উদ্দেশ্য হলো দুর্নীতি নির্মূল করা। আর ঘুস লেনদেনের অবসান এবং দুর্নীতির উৎস নির্মূলের লক্ষ্যেই ফাঁদ মামলা পরিচালনা করা হয়। সাধারণত সরকারি সেবা প্রদানকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী সেবার বিনিময়ে ঘুস বা উপঢৌকন দাবি করলে কমিশন থেকে অনুমোদনের ভিত্তিতে ফাঁদ মামলা পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ আলোকে ঘুস দাবিকারী কর্মকর্তাদের হাতেনাতে ধরতে কমিশন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী অথবা সরকারি কাজে নিয়োজিত কোনো ব্যক্তি কোনো কাজের জন্য ঘুস দাবি করলে ঘুস দেওয়ার আগেই তথ্যটি দুদকের প্রধান কার্যালয়ে অথবা হটলাইনে অথবা নিকটস্থ দুদক কার্যালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে জানালেই ঘুস গ্রহণকারীকে ফাঁদ পেতে হাতেনাতে ধরার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
গতি হারাচ্ছে কার্যক্রম : প্রায় আট বছর ধরে দুদক ফাঁদ মামলা পরিচালনা করে আসছে। তবে বর্তমানে এই কার্যক্রম অনেকটাই গতি হারাচ্ছে। ২০১৪ সালে ফাঁদ মামলার কার্যক্রম শুরু করে দুদক। ওই বছর ৫টি ফাঁদ মামলা করা হয়। এরপর থেকে সেবাগ্রহীতারা দুদকে অভিযোগ করতে থাকেন। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে দুদকের ফাঁদ মামলা। ২০১৬ সালে এসে এ কার্যক্রম গতি পায়। ২০১৭ সালের শুরুর দিকে দুদকের তৎকালীন চেয়ারম্যান সংবাদ সম্মেলন করে সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের প্রতি ঘুস গ্রহণ না করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানান। ‘তা না হলে কঠিন পরিণতির জন্য অপেক্ষা করুন’-বলে হুঁশিয়ারি দেন।
সেই সঙ্গে সরকারি দুর্নীতিপ্রবণ অফিসগুলোর কর্মকর্তাদের ফাঁদ পেতে গ্রেফতারের জন্য কমিশনের প্রতিটি কর্মকর্তার প্রতি কঠোর নির্দেশনা দেন। আর ওই নির্দেশনার পর থেকেই ফাঁদ মামলার সংখ্যা হু-হু করে বাড়তে থাকে। ২০২০ সাল পর্যন্তও এ কার্যক্রমে একটি ধারাবাহিকতা ছিল। তবে গেল বছরই এ কার্যক্রম তিনগুণ কমে গিয়ে ধস নামে। দুদকের গত আট বছরের ফাঁদ মামলার পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৪ সালে ৫টি ফাঁদ মামলা করা হয়। ২০১৬ সালে ১৩টি, ২০১৭ সালে ২৪টি, ১০১৮ সালে ১৫টি, ২০১৯ সালে ১৬টি, ২০২০ সালে ১৮টি ও ২০২১ সালে ৬টি ফাঁদ মামলা করা হয়। তবে দুদকের গত আট বছরের ফাঁদ মামলার কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শতভাগ মামলায় চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিলের অনুমোদন দিয়েছে কমিশন।