মানবাধিকার সমুন্নত রেখে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্যদের কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন বাহিনীর মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। মঙ্গলবার (২৯ মার্চ) সকালে ‘র্যাব মেমোরিয়াল ডে’ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তিনি।
দায়িত্বরত অবস্থায় এ পর্যন্ত র্যাবের ২৯ জন সদস্য মারা গেছেন। এ ছাড়াও করোনাকালে সম্মুখ সারির যোদ্ধা হয়ে কাজ করতে গিয়ে ৭ জন মারা যান। তাদের স্মরণে এবং প্রথমবারের মতো র্যাব মেমোরিয়াল ডে-২০২২ উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘বাংলাদেশ আমার অহংকার’ এই মূলমন্ত্রকে বুকে লালন করে আগামীতে আরও উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে আপনারা (র্যাব সদস্যরা) নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করবেন। আপনাদের সার্বিক সাফল্যে র্যাবের ভাবমূর্তি ও কর্মতৎপরতা অনেকগুণে বাড়বে বলে আমি আশাবাদী। সেই সঙ্গে র্যাব সদস্য হিসেবে সব ধরনের ব্যক্তি স্বার্থ, লোভ ও প্রতিহিংসার ঊর্ধ্বে থেকে মানবাধিকার সমুন্নত রেখে আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় র্যাবকে একটি ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে তৈরি করা হয়েছে উল্লেখ তিনি বলেন, র্যাব শুধু অপরাধ দমন করে না, গণমানুষের অকুণ্ঠ আস্থার প্রতীক হয়ে কাজ করে। র্যাব মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। শুধু আসামি গ্রেপ্তারই নয়, দেশের সৃজনশীল কাজেও র্যাবের অবদান রয়েছে।
‘আমরা ২৯ জন প্রাণপ্রিয় র্যাব সদস্যদের হারিয়েছি’ উল্লেখ করে র্যাব ডিজি বলেন, অপারেশন এবং বিভিন্ন কারণে গর্বিত র্যাব সদস্যরা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। আজ তারা আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু রয়েছে তাদের গৌরবোজ্জ্বল সাহসী কার্যক্রম আমাদেরকে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে। আজকের এই দিনে আমরা তাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। তাদের পরিবারের উপস্থিত সব সদস্যের প্রতি গভীর সহানুভূতি ও সহমর্মিতা জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমাদের শহীদ পরিবারের সদস্যদের সব দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে একাত্ম থাকবে। তাদের যেকোনো সমস্যায় নিজ নিজ ব্যাটালিয়নকে জানাবেন, ব্যাটালিয়নের অধিনায়করা তাদের সাধ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করবেন। এ বিষয়ে সব ব্যাটালিয়নে নির্দেশনা দেওয়া আছে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, এই দীর্ঘ পরিক্রমায় আমরা যে ২৯ সদস্যকে হারিয়েছি, করোনার বিরুদ্ধে সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে র্যাব কাজ করতে গিয়ে ৭ জনকে হারিয়েছি। হাজারের বেশি র্যাব সদস্য বিভিন্ন সময় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। বর্তমানে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। র্যাব সব সময় তাদের পাশে আছে। তাদের আর্থিকভাবে যত সাহায্য সহযোগিতা করার দারকার, র্যাবের পক্ষ থেকে তা করা হচ্ছে এবং প্রয়োজনে আরও করা হবে। তাদের মনবল চাঙা রাখতে আমরা পাশে থাকব।
তিনি বলেন, নিহত ও আহত র্যাব সদস্যদের পাশে ছিলাম, আছি এবং আগামীতেও থাকব। তাদের এই সাহসী ভূমিকা সারাদেশের মানুষের কাছে আমাদেরকে গৌরবোজ্জ্বল করেছে। র্যাবের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও নির্ভরতা রয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই আস্থার জায়গা করেছেন র্যাবের নিহত ও হাজারের বেশি আহত সদস্যরা। তাদের এই অবদানকে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
সেবা ও সাহসিকতায় ২০২০ সালের জন্য ৫০ জন এবং ২০২১ সালের জন্য ৫০ জন র্যাব সদস্যকে মহাপরিচালক সম্মাননা পদকে ভূষিত করা হয়েছে। এ সময় পদকপ্রাপ্তদের আন্তরিক অভিনন্দন জানান র্যাব ডিজি। তিনি বলেন, এর মানকে ধরে রেখে র্যাবের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি আরও প্রসারিত করবেন।
সুন্দরবনকে জলদস্যু মুক্ত করতে র্যাবের ভূমিকা প্রসঙ্গে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, গত এক বছরে র্যাবের উল্লেখযোগ্য সাফল্য ছিল বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনকে জলদস্যু মুক্ত ঘোষণা করা। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুন্দরবনকে ‘জলদস্যু মুক্ত‘ ঘোষণা করেন। ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত র্যাবের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে সুন্দরবনের ৩২৮ জন জলদস্যু পুনর্বাসিত হয়েছেন। র্যাবের মাধ্যমে পাওয়া অনুদান প্রত্যেক জলদস্যুকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। এ বছর আমাদের মাধ্যমে তাদের ১০২টি ঘর, ৯০টি মুদি দোকান (মালামালসহ), ১২টি জাল ও মাছ ধরার নৌকা, ৮টি ইঞ্জিন চালিত নৌকা এবং ২২৮টি গবাদিপশু দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়াও এ পর্যন্ত ৩২টি জলদস্যু-বনদস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন সদস্য, ৪৬২টি অস্ত্র ও ২২ হাজার ৫০৪ রাউন্ড গোলাবারুদসহ র্যাবের কাছে আত্মসমর্পন করেছে। তাদের আত্মসমর্পণ করানোর মধ্যেই র্যাব ক্ষান্ত হয়ে যায়নি। বরং এদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে। সুন্দরবনে আজ শান্তির সুবাতাস বইছে। এ ছাড়াও র্যাবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কক্সবাজার ও মহেশখালী উপকূলীয় অঞ্চলের ১৮টি বাহিনীর ৭৭ জন সদস্য ১৮৮টি অস্ত্র ও ৯ হাজার ৭০৩ রাউন্ড গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করেছেন। এরই মাধ্যমে আমরা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২৫ লাখ বনজীবীর জন্য স্বস্তির দুয়ার খুলে দিতে পেরেছি। এর সিংহভাগ কৃতিত্ব এলিট ফোর্স র্যাবের।
এ ছাড়াও বিগত বছরগুলোতে র্যাবের ‘মাদকবিরোধী’ বিশেষ অভিযান ছিল র্যাবের অন্যতম একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। এ বিশেষ অভিযানে গুলিবিনিময়ে ১০০ জন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হন। অভিযানে গুলিবিদ্ধ হন ৬ জন র্যাব সদস্য। অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের নিদর্শন স্বরূপ ২০২০ এবং ২০২১ সালে মোট ৬০ জন র্যাব সদস্যকে প্রধানমন্ত্রী বিপিএম (সাহসিকতা) পদকে ভূষিত করেছেন। আর এমনিভাবেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি জঙ্গি, চরমপন্থী ও সন্ত্রাস দমন, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার, অবৈধ মাদকদ্রব্য উদ্ধার, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা রোধ, ভেজাল বিরোধী অভিযান, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও গতিশীল রাখা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা কর্মসূচিতে র্যাবের বীরগাঁথা অবদান সর্ব মহলে ভূয়সী প্রশংসিত হয়েছে।
অপহরণকৃত ভুক্তভোগী উদ্ধারে র্যাবই হচ্ছে মানুষের শেষ ভরসাস্থল উল্লেখ করে ডিজি বলেন, শুরুতে র্যাব চারটি ব্যাটালিয়ন নিয়ে যাত্রা করলেও সময় ও পরিস্থতির দাবি মোতাবেক সর্বশেষ কক্সবাজারসহ বর্তমানে র্যাব মোট ১৫টি ব্যাটালিয়নের মাধ্যমে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণসহ সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সব ধরনের সন্ত্রাসী-অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সমন্বিত পরিকল্পনা ও গোয়েন্দা কার্যক্রমের মাধ্যমে সফল অভিযান পরিচালনা করে র্যাব ফোর্সেস আজ একটি সুসংগঠিত ও গতিশীল বাহিনী হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত।
কর্মরত সব সদস্যের আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, মেধা ও পরিশ্রমের ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে র্যাব ফোর্সেস সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। আজকের এ দিনে আমি সততা ও নিঃস্বার্থভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য আপনাদের সবাইকে আবারও আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। তিনি বলেন, এই গত দেড় যুগের দীর্ঘ পথ- পরিক্রমায় র্যাবের কর্মকলেবর বহুগুণে বেড়েছে। নানা চ্যালেঞ্জ ও বৈচিত্র্য এসেছে অভিযানে, ফলে ভিন্নতা পেয়েছে শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার গতানুগতিক কার্যক্রমে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠায় র্যাবকে একটি আধুনিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। দেশে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা প্রতিরোধের মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠায় র্যাবের প্রতিটি ব্যাটালিয়ন তাদের নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে সদা তৎপর রয়েছে।