প্রায় তিন বছর পর জোটনেত্রীকে পেলেন শরিক দলের নেতারা। একসঙ্গে কাটালেন প্রায় চার ঘণ্টা। কুশল বিনিময়, ব্যক্তিগত খোঁজখবর, অভিনন্দন, কৃতজ্ঞতা, ক্ষোভ, অসন্তোষ সবকিছুর মিশ্রণ ছিল টানা বৈঠকে। আরও ছিল পাওয়া-না পাওয়ার কথাও। শেষ পর্যন্ত একসঙ্গে চলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন সবাই। তাই আগামী নির্বাচনেও জোটবদ্ধ হয়ে থাকবেন বলে জানান শরিক দলের নেতারা। অন্যদিকে জোটনেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোটকে সঙ্গে নিয়ে দ্বাদশ নির্বাচন করতে চান বলে শরিকদের জানান। পাশাপাশি তাদের ক্ষোভ ও অসন্তোষের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনার আশ্বাস দেন।
গতকাল গণভবনে বেলা ১১টায় ১৪ দলীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সাড়ে ৩টায় বৈঠক শেষ হয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও ১৪ দলীয় জোটনেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, ফজলে হোসেন বাদশা, জাসদের হাসানুল হক ইনু, শিরিন আকতার, সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া, তরীকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমানসহ কেন্দ্রীয় ১৪ দলীয় নেতারা।
বৈঠকে উপস্থিত শরিক দলের এক নেতা মানবজমিনকে বলেন, বৈঠকে খোলামেলাভাবে অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে সরকারের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে। সেখানে বলা হয়, সরকারের অনেক সেক্টর অনিয়ম ও দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। এসব বন্ধ করা জরুরি। সরকারের শরিক দল হিসেবে এসব নেতিবাচক বিষয়ের দায়ভার আমাদের ওপরও বর্তায়। সামনে নির্বাচন। তাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেয়া এখনই জরুরি। জোটের আরেক নেতা জানান, দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও সরকারপ্রধানকে জানানো হয়েছে। জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব বিষয়ে তার নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। পাশাপাশি এসব নিয়ে আরও জোরালো পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানান। এদিকে শরিক দলের অপর এক নেতা বৈঠকে বলেন, আমরা ছোট দল।
কয়েক বছরের মধ্যে আমাদের আর্থিক অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে গেছে। সরকার বা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। জবাবে জোটপ্রধান শেখ হাসিনা সব ধরনের অসুবিধা বিবেচনার আশ্বাস দেন। এদিকে জোট নেতাদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতাও জানানো হয়। বিশেষ করে করোনাকালে প্রধানমন্ত্রীর নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের ভূয়সী প্রশংসা করেন তারা। পাশাপাশি ভূ-রাজনীতিতে অসাধারণ ভারসাম্য রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বকে অনুকরণীয় বলে উল্লেখ করেন শরিক দলের নেতারা। বৈঠক প্রসঙ্গে সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া মানবজমিনকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও আগামী নির্বাচন নিয়ে আমাদের মধ্যে বিস্তারিত কথা হয়েছে। সেখানে আমরা বলেছি, অতীতের মতো আগামী নির্বাচনেও আমরা জোটবদ্ধ হয়ে জনগণের কাছে যাবো।
সরকার গঠনে একসঙ্গে কাজ করবো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একই ইচ্ছার কথা আমাদেরকে বলেছেন। দিলীপ বড়ুয়া বলেন, সরকারের দুর্নীতি ও দ্রব্যমূল্যের বিষয়টি নিয়ে আলাপ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ আরও জোরালো হবে। এদিকে বৈঠকে জোট নেতারা বলেন, আগামী নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোট ঐক্যবদ্ধ থাকবে। নির্বাচনের আগে অন্য কোনো দল এলে জোটের পরিসর বাড়তে পারে, না এলেও ১৪ দলীয় জোট ঐক্যবদ্ধ থেকেই দ্বাদশ নির্বাচনে মাঠে ঐক্যবদ্ধ থাকবে।
শরিক জোটের এক নেতা বলেন, আমরা বলেছি ১৪ দলীয় যে জোট সেটি আদর্শিক জোট। দীর্ঘদিন এই জোট সক্রিয় নেই। জোট থাকলেও কোনো কার্যক্রম নেই। কিছুদিন আগে হেফাজত যে তাণ্ডব চালিয়েছে সেটি প্রতিহত করতে ১৪ দলীয় জোট কোনো ভূমিকা রাখেনি। বৈঠকে এক নেতা বলেন, আমরা জোটগতভাবে নির্বাচন করলাম। এরপর বিজয়ী হয়ে আমাদের বিরোধী বানিয়ে দিলেন। দূরে ঠেলে দিলেন। আবার বিরোধী হয়েও ৭২ অনুচ্ছেদের কারণে সঠিকভাবে ভূমিকা রাখতে পারছি না। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, গত নির্বাচনের পর এক প্রেক্ষাপটে আপনাদের বিরোধী দল হিসেবে শক্তিশালী হতে বলেছিলাম। পরবর্তীতে আমাদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আগামীতে বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হবে।
বৈঠক শেষে নেতারা যা বললেন: বৈঠক শেষে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪ দল জোটবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করবে বলে জানিয়েছেন আমির হোসেন আমু। তিনি বলেন, ১৪ দলের সঙ্গে ঐক্য বজায় থাকবে। জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করা হবে। সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানে ১৪ দলের যে ভূমিকা সেটিও অব্যাহত থাকবে। নির্বাচনে আসন বণ্টনের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবীণ এ নেতা বলেন, এখনই আসনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে না। এ জন্য আরও আলোচনা প্রয়োজন। অনেক বিষয়ের ওপর আসন বণ্টন নির্ভর করে। এ আলোচনা নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পরে হবে। বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে তখন কি জোটবদ্ধ নির্বাচন হবে? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আমু বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে না এটা তারা বলছে।
কিন্তু শেষ মুহূর্তে কী করবে এটা দেখার পর আমরা সিদ্ধান্ত নেবো। বিএনপি’র দেশব্যাপী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ১৪ দল মাঠে নামবে জানিয়ে তিনি বলেন, বিএনপির আন্দোলনের বিরুদ্ধে ১৪ দল মাঠে নামবে। প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগকে যে নির্দেশ দেবেন- সে অনুযায়ী ১৪ দলকে ঐক্যবদ্ধ করে কাজ শুরু করা হবে। জাতীয় পার্টির (জেপি) আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন হবে। দ্রব্যমূল্য সম্পর্কে বলেছেন নিয়ন্ত্রণের রাখার সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। বিএনপি নির্বাচনে না আসলে কি জোট থাকবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জোট থাকবে। জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন হবে। এটা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ১৪ দলীয় জোটের ঐক্য, বর্তমান পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্য সবই আলোচনা হয়েছে।
খুবই খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীও আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। বহুদিন পরে একটা ভালো আলোচনা হয়েছে। আমরা বলেছি সরকারের সঙ্গে ১৪ দলের সম্পর্কে যে প্রশ্নটা আছে, সেটাও আপনার নির্মূল করতে হবে। কারণ সব ব্যাপারে আমরা একমত নই। সব বিষয় আমরা মেনে নিয়েছি- ব্যাপারটা এ রকম নয়। সুতরাং যেখানে যেটা আছে, সেখানে কোনো ব্যত্যয় থাকলে, বিষয়টি আলোচনায় আসে। আপনি যে বিভিন্ন সময় জনগণের ভোটের নিশ্চয়তা দাবি করেছিলেন। সেই বিষয়ে কি আজকে আলোচনা করেছেন সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একেবারে স্পষ্টভাবে বলেছি গত ইউপি নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে যে প্রশ্নগুলো এসেছে, জনগণের ভোটদানের অধিকারের যে প্রশ্নটি এসেছে, এসব ব্যাপার নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
জোটনেত্রী কী বলেছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে মেনন বলেন, নেত্রী কী সব প্রশ্নের উত্তর দেবেন? জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, সরকারি দলের কাছে চাওয়া-পাওয়া নিয়ে আলোচনা হয়নি। আলোচনাটা হয়েছে ১৪ দলীয় জোট প্রসঙ্গে। আমরা মূলত কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। সেটি ফলপ্রসূ হয়েছে। বাংলাদেশে এখনো রাষ্ট্রের চিরশত্রু, সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী এবং সন্ত্রাসী শক্তি রাষ্ট্রের মূলভিত্তিতে হামলা ও আঘাত করছে। তাই আমরা মনে করি এখনো ১৪ দল রাখার প্রয়োজন রয়েছে। তেল, গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম যেন বৃদ্ধি না করা হয়, সেই বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী বিএনপি সম্পর্কে বলেছেন, তারা একটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক জোটের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত এবং স্বাধীনতাবিরোধী চক্র জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ।
তাই তিনি চান আওয়ামী লীগের বিকল্প একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হোক। সেটি ১৪ দলভুক্ত, আমাদের রাজনৈতিক মূল ভিত্তি হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক এবং স্বাধীনতার পক্ষের চেতনা। সুতরাং সেই শক্তির থেকে আরেকটি বিকল্প শক্তির উত্থান হোক সেটাই ওনার প্রত্যাশা।