কারসাজি করে সয়াবিন তেলের মাত্রাতিরিক্ত দাম বাড়িয়েছে মজুতদাররা। এতে গত দেড় মাসে ভোক্তার পকেট থেকে বেরিয়ে গেছে গড়ে অতিরিক্ত প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। এই টাকার বড় অংশই গেছে মিলার ও পাইকারদের কাছে। তেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে তারা পর্যায়ক্রমে দাম বাড়িয়েছে। সীমিত কিছু অংশ গেছে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে।
৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত সরকার নির্ধারিত দরের তুলনায় কত বেশি অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে, সেই হিসাব-নিকাশে পাওয়া উল্লিখিত তথ্য। এর আগে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান এক বৈঠকে বলেছিলেন, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের কাছ থেকে ১৫ দিনে ১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে হবে। তদারকি জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি কোন পর্যায় থেকে তেল নিয়ে কারসাজি হয়েছে তা চিহ্নিত করতে হবে। পাশাপাশি একটি কমিটি করে চিহ্নিতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রয়োজনে আরও কঠোর আইন করতে হবে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, আমরা তেলের কারসাজি রোধে মিল পর্যায়ে অভিযান পরিচালনা করছি। পাইকারি ও খুচরা পর্যায়েও অভিযান চালিয়েছি। অসাধুতায় জড়িত অনেক প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছি। এতে দেখা গেছে তেল নিয়ে বড় ব্যবসায়ীরাই জড়িত। আমরা আরও তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করছি। আশা করছি অসাধুদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।
সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম জানুয়ারিতে ছিল প্রতি টন ১ হাজার ৩০০ ডলার। ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮৬০ ডলার। এর প্রভাবে স্থানীয় বাজারেও তেলের দাম বেড়েছে। ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৬ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।
বৈঠক শেষে বিশ্ব বাজারের মূল্য পরিস্থিতি বিবেচনায় ভোজ্যতেলের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়। এই দর ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে বর্তমান পর্যন্ত কার্যকর আছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন ১৬৮ টাকা, খোলা সয়াবিন ১৪৩ টাকা ধরা হয়। এ সময় বলা হয়-এ নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কেউ যদি বেশি দরে বিক্রি করে তাহলে আইনের আওতায় আনা হবে।
কিন্তু এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম আরও বাড়লে ব্যবসায়ীরা এর দাম লিটারে ১২ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করলে মন্ত্রণালয় তা নাকচ করে দেয়। এরপর থেকেই বাজারে সয়াবিনের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়াতে থাকে মিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। অনেকে তেল মজুত করতে শুরু করে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সকারের বেঁধে দেওয়া দামে তেল বিক্রির কথা থাকলেও বাজারে বিক্রি হয়েছে বাড়তি দরে। এ দিন রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন প্রতি লিটার ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়।
যা নির্ধারিত দরের চেয়ে ৭ টাকা বেশি। বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন বিক্রি হয় ১৭০ টাকা। যা নির্ধারিত দামের চেয়ে ২ টাকা বেশি। গড়ে প্রতি লিটারে বেশি দাম নিয়েছে সাড়ে ৪ টাকা। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি ৪ দিন এই দামে সয়াবিন বিক্রি হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে সয়াবিনের চাহিদা ৫০ হাজার টন। কেজি হিসাবে ৫ কোটি কেজি। এ হিসাবে প্রতিদিন ভোক্তার কাছ থেকে বেশি নেওয়া হয়েছে ২২ কোটি টাকা। ৪ দিনে বেশি নেওয়া হয়েছে ২৮৮ কোটি টাকা।
১১ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি এই ৭ দিন খোলা সয়াবিন বিক্রি হয় ১৫৫ টাকা ও বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হয় ১৭০ টাকা দরে। ওই সময়ে গড়ে নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রতি লিটারে ৭ টাকা বেশি নেওয়া হয়েছে। এ হিসাবে ১ দিনে বেশি নেওয়া হয়েছে ৩৫ কোটি টাকা। ৭ দিনে বেশি নেওয়া হয়েছে ২৪৫ কোটি টাকা। ১৮ থেকে ২৪ ফেব্রয়ারি এই ৭ দিন খোলা সয়াবিন ১৬৫ টাকা ও বোতল ১৭০ টাকা করে বিক্রি হয়। ওই সময়ে প্রতি লিটারে গড়ে বেশি নেওয়া হয়েছে ১২ টাকা করে। এ হিসাবে প্রতিদিন বেশি নেওয়া হয়েছে ৬০ কোটি টাকা। ৭ দিনে নেওয়া হয়েছে ৪২৫ কোটি টাকা।
২৫ ফেব্রুয়ারি থেক ২ মার্চ এ ৬ দিন প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৬৮ ও বোতলজাত ১৮০ টাকায় বিক্রি হয়। ওই সময়ে প্রতি লিটারে সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি নেওয়া হয়েছে ১২ টাকা করে। এ হিসাবে এক দিনে বেশি নেওয়া হয়েছে ৬০ কোটি টাকা। ৬ দিনে বেশি নেওয়া হয়েছে ৩৬০ কোটি টাকা। ৩ থেকে ১৩ মার্চ এই ১১ দিন প্রতি লিটার তেল বিক্রি হয় গড়ে ২০০ টাকা করে। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রতি লিটারে বেশি নেওয়া হয়েছে ৩২ টাকা। এ হিসাবে প্রতিদিন বেশি নেওয়া হয়েছে ১৬০ কোটি টাকা।
১১ দিনে বাড়তি নেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ মার্চ এই ৪৫ দিনে ভোক্তার পকেট থেকে সয়াবিন তেলের সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি লোপাট করা হয়েছে ২ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে ভোক্তার পকেট থেকে। এমন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে ১৪ সংস্থার একটি অভিযান টিম গঠন করা হয়। তারা মাঠপর্যায়ে কাজ করছে।
পাশাপাশি ভোক্তা অধিদপ্তর নিয়মিত মিল পর্যায় থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে। অনিয়ম পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি প্রদান করছে। পাশাপাশি ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। এছাড়া উৎপাদন ও পাইকারি পর্যায়ে ২০ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করে সোমবার। এদিকে আমদানি পর্যায়েও ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহার নিয়ে গুজব : ভোজ্যতেল আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহার নিয়ে মঙ্গলবার দিনভর গুজব ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন রিফাইনারি, পাইকারি বাজার থেকে শুরু করে গুজব এসে ঠাঁই নেয় বিভিন্ন অনলাইন নিউজপোর্টালেও। সেখানে বলা হয়, আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা গাজী তৌহিদুল ইসলামের বরাত দিয়ে অনেকে ছড়িয়ে দেন ভ্যাট প্রত্যাহারের বিষয়। বিষয়টি নিশ্চিত করতে যোগাযোগ করা হলে গাজী তৌহিদুল ইসলাম বলেন, আমার কাছে কেউ জানতে চায়নি, আমি কাউকে কোনো বক্তব্য প্রদান করি নাই।
এটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এখতিয়ার। এর আগে দুপুর থেকে বলা হয় উৎপাদন ও ভোক্তা পর্যায়ে সয়াবিন তেলের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহারের পর এবার আমদানি পর্যায়েও ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। উল্লেখ্য, সোমবার উৎপাদন ও ভোক্তা পর্যায়ে সয়াবিন তেলের ওপর ২০ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করে প্রজ্ঞাপন জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আর আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহারের গুজবে ভোজ্যতেল রিফাইনারি ও পাইকাররা সুবিধা নিতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে মঙ্গলবার রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এনবিআর থেকে ভোজ্যতেল আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহারের কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করেনি।