‘মানবিক চিকিৎসকের’ এক অনন্য নজির স্থাপন করলেন যশোরের সিভিল সার্জন ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস। সঙ্কটাপন্ন দুই গর্ভবতীর জীবন বাঁচাতে আলোচনা অনুষ্ঠান ছেড়ে ছুটলেন অপারেশন থিয়েটারে। নিজের হাতেই তুলে নিলেন ছুরি-কাঁচি। অভাবনীয় এ ঘটনাটি ঘটেছে শনিবার দুপুরে যশোরের চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। রোববার এই ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে প্রশংসার জোয়ারে ভাসছেন তিনি।
শনিবার চিকিৎসক-নার্সদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে গিয়েছিলেন জেলার সিভিল সার্জন ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস। মতবিনিময়কালে তিনি যখন দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রসূতি ওয়ার্ডে প্রসবযন্ত্রণায় কাতর দুই গর্ভবতী নারী। দ্রুত সিজারিয়ান অপারেশন না করলে বাঁচানো যাবে না দুই প্রসূতিকে। কিন্তু সিজার হবে কিভাবে, হাসপাতালে যিনি সিজার করবেন সেই একমাত্র গাইনি চিকিৎসক ছুটিতে। চিকিৎসক না থাকায় চিন্তিত হয়ে পড়েন প্রসূতিদের স্বজন ও নার্সরা।
এমন সময় সিভিল সার্জন বক্তব্য রেখে তার সঙ্গে থাকা অন্যান্য চিকিৎসকদের নিয়ে সিজারিয়ান অপারেশনের দায়িত্ব নিজের কাঁধেই তুলে নেন। ঘণ্টা খানিকের মধ্যে পরপর দুটি সিজারের মাধ্যমে দুই প্রসূতির কোলে এনে দিলেন দুটি ফুটফুটে পুত্র সন্তান। অপারেশনের পর জন্ম নেওয়া ওই একজোড়া নবজাতক ও দুই মা’ই সুস্থ রয়েছেন।
চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সিজার দুটি হলেও প্রসূতি মায়ের কেউই চৌগাছা উপজেলার বাসিন্দা নন। প্রসূতি সুমাইয়া খাতুন (১৯) ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার বৈচিতলা গ্রামের রিংকু এবং প্রসূতি শাহানারা (৩০) যশোর সদর উপজেলার হৈবতপুর ইউনিয়নের মথুরাপুর গ্রামের টিটো মিয়ার স্ত্রী।
এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. লুৎফুন্নাহার বলেন, আমাদের স্থায়ী কোনো স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। ডা. হাবিবুন নাহার ফোয়ারা একাই সিজারিয়ান অপারেশন করে থাকেন। তবে শনিবার তিনি ব্যক্তিগত কারণে ছুটিতে ছিলেন। অথচ দুজন প্রসূতির সিজার করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছিল। ওই সময়ে সিজার না করালে তাদের জীবন সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়তো।
ওই সময়ে হাসপাতালে চিকিৎসক-নার্সদের সঙ্গে মতবিনিময় করছিলেন সিভিল সার্জন ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস। এমন সময় হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ড থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার নিকট ইন্টারকমে নার্সরা জানান, জরুরি সিজার করতে হবে দু’জন প্রসূতিকে। পরে সিভিল সার্জন মহোদয়কে জানালে সঙ্গে সঙ্গে তিনি অপারেশন থিয়েটার রেডি করার নির্দেশ দেন। পরে সিভিল সার্জন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মিলে দুই প্রসূতিকে সিজার করেন। সিজারে দু’জন প্রসূতির দুটি ছেলে সন্তান হয়েছে।
প্রসূতি সুমাইয়া বলেন, আমি কিছুই জানি না। অপারেশনের পরে আমার ননদের কাছে শুনি, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আর সিভিল সার্জন সিজার করেছেন। সঠিক সময়ে আমার সিজার না করলে নাকি আমাকে বাঁচানো যেত না! আল্লাহর পরেই তো চিকিৎসকরা মানুষের জীবন বাঁচান। আমি সেটা বুঝতে পেরেছি। বর্তমানে আমি আর আমার সন্তান ভালো রয়েছি।
আরেক প্রসূতির স্বামী টিটু মিয়া বলেন, আমার স্ত্রী ও ছেলে ভালো আছে। যশোরের মধ্যে চৌগাছায় সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা হয়। কিন্তু সঠিক সময়ে গাইনি চিকিৎসক না থাকায় একটি দুর্ঘটনার মধ্যে পড়েছিলাম। তারপরও আল্লাহ সিভিল সার্জনের ওসিলায় দুর্ঘটনা থেকে বাঁচিয়েছেন।
এ বিষয়ে সিভিল সার্জন ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস বলেন, শনিবার দুপুরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটা অনুষ্ঠানে ছিলাম। হঠাৎই ওই হাসপাতালে দুই প্রসূতিকে সিজারের দরকার হয়ে পড়ে। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে হাসপাতালে সিজারের জন্য ওই সময়ে চিকিৎসক ছিলেন না। তাই বাধ্য হয়ে আমি সিজার করেছি। এর আগে প্রায় ১ হাজারের বেশি সিজার করার অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার। তবে এমন বিপদগ্রস্ত অবস্থায় কোনো প্রসূতিকে অপারেশন করিনি। আমার অপারেশন করতে ভালো লাগে এবং আমি সবসময়ই প্রস্তুত থাকি। তবে ভালো লাগছে প্রসূতি দুজন ও তাদের দুই সন্তানই ভালো রয়েছে।
প্রসঙ্গত, চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি প্রসূতি সেবায় ২০০৪ সাল থেকে পরপর কয়েক বছর উপজেলা পর্যায়ে খুলনা বিভাগের সেরা হয়ে আসছে। প্রসূতি স্বাস্থ্য সেবায় অনন্য অবদানের জন্য হাসপাতালটি বারবার পুরস্কৃত হয়ে আসছে। এ কারণে যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও সাতক্ষীরা জেলার ৮ থেকে ১০টি উপজেলার বাসিন্দারা প্রসূতি সেবা নিতে চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন। ফলে প্রতিদিন হাসপাতালটিতে গড়ে ৪ থেকে ৬টি সিজারিয়ান অপারেশন হয়ে থাকে। তবে হাসপাতালটিতে স্থায়ী কোনো স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। প্রেষণে একজন গাইনি কনসালট্যান্ট দিয়ে এখানকার প্রসূতি বিভাগের কার্যক্রম চালানো হয়।