পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়/ও-সে চোখের দেখা প্রাণের কথা, সেকি ভোলা যায়।’ হারানো অতীতের ধূসর স্মৃতি সতত মধুর। যৌবনের ঊষালগ্নে দাপিয়ে বেড়ানো সেই অমলিন স্মৃতি খুঁজে বেড়াতে শনিবার প্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরেছিলেন সাবেক শিক্ষার্থীরা। প্রতিষ্ঠার একশ’বর্ষ উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন (ডুয়া) কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে আয়োজন করেছিল শতবর্ষের মিলনমেলা।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অ্যালাইমনাই ১৯৫০ ব্যাচের ছাত্র সাবেক সচিব মো. মতিউল ইসলাম। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি একে আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি রকীব উদ্দীন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষ উদ্যাপন কমিটির চেয়ারম্যান ও সাবেক সভাপতি সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল প্রমুখ।
এর আগে সকাল সাড়ে ৮টায় প্রাতঃরাশের মাধ্যমে সাবেক শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানানো হয়। ১০টায় জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের শুভসূচনা হয়। এ ছাড়া পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহ থেকে পাঠ ও শোক প্রস্তাব পাঠ করা হয়। একই সঙ্গে মিলনমেলা উপলক্ষ্যে প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থ মোড়ক উন্মোচন আর ১০০ শিল্পীর ১০০ ছবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রপ্রদর্শনীও উদ্বোধন করা হয়। এ পর্বে শত রঙিন বেলুন উড়ানো হয় নীল আকাশে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মো. মতিউল ইসলাম বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে স্বাধীনতার মাসে আয়োজিত এই বছরের অনুষ্ঠানের একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। তিনি বলেন, ৭০ বছরের এ কর্মজীবনে অসংখ্য অর্জনের মধ্যে আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির এই সম্মান অনেক বড়। ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ড. মু. সামাদ বলেন, বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রের বিকাশ এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত হয়ে আছে মুক্তবুদ্ধি চর্চার প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছে।
উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার শতবছরে এসে প্রায় ৩৩ লাখ গ্রাজুয়েট তৈরি করেছে যা কোনো কোনো দেশের নাগরিকের সংখ্যার চেয়েও বেশি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো নির্মাণ ও শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা প্রদানে অ্যালামনাইদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
সভাপতির বক্তব্যে অ্যালামনাই সভাপতি একে আজাদ বলেন, ‘শতবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে পৌঁছানোর কথা ছিল সেখানে আসতে পারেনি। আমরা দেখেছি বিশ্বের ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিংয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ র্যাংকিংয়ের ভেতরে আনতে আমাদের সংগঠন কাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী অর্থাভাবে যথাযথভাবে তাদের শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে না। ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন তাদের জন্য কাজ করবে।’
মোট চার পর্বে বিভক্ত ছিল গোটা অনুষ্ঠান। দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় সাড়ে ১২টার দিকে। দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে ‘বাংলাদেশের পদযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান শুরু হয়। ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ডাকসুর সাবেক জিএস বেগম মতিয়া চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি এবং খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুক্তিযোদ্ধা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, লেখক ও রাজনীতিবিদ ইনাম আহমদ চৌধুরী, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক হামিদা আখতার বেগম, এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মীর নাসির, ডুয়ার কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য শামসুজ্জামান দুদু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. রহমত উল্লাহ প্রমুখ বক্তব্য দেন।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমি নয় বছর ডাকসুর কোষাধ্যক্ষ ছিলাম এবং সেই নয় বছর দেশে সামরিক শাসন ছিল। তখনো কিন্তু ছাত্র সংসদ ছিল। তারপর যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এলো তখন থেকে আশ্চর্যের বিষয় ছাত্র সংসদের নির্বাচন থেমে গেল। ছাত্র সংসদের নির্বাচন ছিল উৎসব। সেখান থেকে মেধাবী নেতৃত্ব বেরিয়ে আসত। মেধাহীন ছাত্ররা কখনো নির্বাচিত হতে পারত না। চৌকস ছেলেরা নেতৃত্বে আসত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সামাজিকতা শিখিয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয় সহমর্মিতা শিখিয়েছে, আর্তমানবতার জন্য ক্রন্দন করতে শিখিয়েছে। একাত্তর সালে আমরা দেখেছি এই বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে পাকিস্তানকে তাড়িয়েছিল।
অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে অনুভূতি ব্যক্ত করেন অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান, ১৯৬৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী সুফিয়া খাতুন, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, ডাকসুর সাবেক ভিপি ও তারকা রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেনন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, ডাকসুর সাবেক জিএস খায়রুল কবীর খোকন, সাবেক এজিএস নাজিমউদ্দিন আলম, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু প্রমুখ।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, এই দিনটি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের আনন্দমুখর দিন। তাদের প্রাণের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শততম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, এজন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি স্বাভাবিকভাবেই গর্বিত। কেননা এ সময়ে আমরা এদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশের সব স্তরে সাফল্যের সঙ্গে অবদান রাখছেন।
তিনি বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এ দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। স্বাভাবিকভাবেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে মানুষের প্রত্যাশাও অনেক বেশি। দেশের সব আন্দোলন সংগ্রামে এই বিশ্ববিদ্যালয় নেতৃত্ব দিয়েছে এবং এখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আত্মাহুতি দিয়েছেন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে স্বৈরাচারের অবসান করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ই নেতৃত্ব দিয়েছে। এ ছাড়া গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় এই বিশ্ববিদ্যালয় ভূমিকা রাখছে। আমরা চাই এই বিশ্ববিদ্যালয় তার পুরোনো গৌরব ফিরে পাক।
রাশেদ খান মেনন বলেন, আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছর দেখেছি, এবার শতবছরও দেখলাম। এই অনুভূতি আনন্দের অনুভূতি। এটা আমার জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। আমাদের সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে জাতিকে স্বাধীনতার যুদ্ধের জন্য অনুপ্রেরণা দিতে পেরেছিলাম। তারই পরিণতি আজকের বাংলাদেশ। আমরা এখনো এই বিশ্ববিদ্যালয়কে এ দেশের পথপ্রদর্শক হিসাবে মনে করি।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, শিক্ষা ও গবেষণায় যেমন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য ভূমিকা রয়েছে, তেমনি আমাদের ইতিহাস বিনির্মাণেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বড় একটা ভূমিকা রয়েছে। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন কিংবা গণতান্ত্রিক সংগ্রামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য ভূমিকা রয়েছে। আমি আশা করব সেই অতীত ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে, শতবর্ষের কথা মাথায় রেখে আগামী একশ’ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়কে অনন্য উচ্চতায় নেওয়ার কথা ভাবতে হবে।
তৃতীয় পর্বে বিকালে ছিল শতবর্ষের শত গুণীজনকে মরণোত্তর সম্মাননা। এতে ১৬টি ক্যাটাগরিতে বিশিষ্ট নাগরিকদের সম্মাননার জন্য বাছাই করা হয়। অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গুণীদের নির্বাচন করে। ক্যাটাগরিগুলোর মধ্যে সূচনাপর্বের ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সম্মাননার তালিকায় আছেন-প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য স্যার পি জে হার্টগ, সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, খাজা নবাব সলিমুল্লাহ ও শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে সম্মাননার তালিকায় আছেন-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। এ ছাড়া উপাচার্য, ভাষা আন্দোলন, বিভিন্ন আন্দোলনে শহিদ, শহিদ শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট নারী এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, সাহিত্য, ক্রীড়া, শিল্পকলায় অবদান রাখা ব্যক্তিরা সম্মাননার তালিকায় রয়েছেন। এ বছরই আনুষ্ঠানিকভাবে এসব ব্যক্তির পরিবারের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে।
অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে সুবিশাল পাঁচটি প্যান্ডেল আর বেশকিছু ছোট তাবু করা হয়। এর একটি ছিল মূল অনুষ্ঠানস্থল আর আরেকটি ভোজনশালা। দুটিতে নারী ও পুরুষদের প্রসাধনাগার ছিল। পঞ্চমটিতে সমাগত দশ সহস্রাধিক অ্যালমানইয়ের রান্না হয়। সব শেষে সন্ধ্যার পর ছিল মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রূপা চক্রবর্তী আর নায়ক ফেরদৌসের উপস্থাপনায় এ পর্ব হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত। ছিল শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনের একক পরিবেশনা। পুরানো দিন আর চিরায়ত গানের পাশাপাশি আধুনিক ও লোকগীতির সুরে বিমোহিত হয়ে সুখ স্মৃতি নিয়ে ফিরে যান দেশের সব স্তরে নেতৃত্ব দেওয়া সাবেক শিক্ষার্থীরা।