বৃষ্টি আক্তার। মাত্র ২৩ বছর বয়সী এই মেয়েটি চাকরি করতেন আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায়। প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর নতুন করে সংসার পাতেন বৃষ্টি। প্রথম স্বামীর পক্ষের এক সন্তান রয়ে যায় বৃষ্টির বাবার বাড়িতেই। দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে আশুলিয়ার ভাড়া বাড়িতে থাকতেন বৃষ্টি। স্বামী আসাদুলও তার সঙ্গে পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। তবে বৃষ্টির বেতন আর স্বামীর চেয়ে বেশি ছিল।
তবে বৃষ্টির মতো প্রতিবাদী নয় উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ২৮ বছরের এই তরুণী। চাকরি জীবন শুরুর পর পরই বিয়ে হয় তার আরেক সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে। বিয়ের আড়াই বছর পেরিয়ে গেছে তাদের। কিন্তু বিয়ের পর থেকে নিজের বেতনের টাকার পুরোটাই স্বামীর হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন তিনি। নিজের প্রয়োজনীয় অর্থ স্বামীর কাছ থেকে চেয়ে নেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই তরুণী যুগান্তরকে বলেন, আমার পরিবার মধ্যবিত্ত। তাদের কোনো চাহিদা না থাকলেও চাইতাম নিজের আয়ের অর্থের একটা অংশ তাদের হাতে তুলে দিতে। কিন্তু প্রথমবার মা-বাবা আর বড় ভাই-ভাবিকে উপহার দেওয়ার পর আমার স্বামী বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। পরে তিনি সরাসরিই এ নিয়ে কথা বলেন।
স্বামীর এইর আচরণের কারণ কী, তার স্ত্রীর অর্থের আসলেই প্রয়োজন আছে কী না জানতে চাইলে ওই তরুণী বলেন, আমার স্বামী স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান। কিন্তু তারপরও আমার উপার্জনের অর্থ নিজের পকেটে পুরতে একটুও দ্বিধা করেন না। তিনি আরও বলেন, প্রথম প্রথম প্রতিবাদ করতাম। পরে পারিবার আর সমাজের কথা চিন্তা করে মেনে নেই। অবশ্য আমার দরকারের সব কিছুই সে বিনা বাক্যে মিটিয়ে দেয়। কিন্তু টাকাটা তার কাছ থেকেই চেয়ে নিতে হয়।
শুধু বৃষ্টি কিংবা ওই তরুণী নন, নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সমাজের সব শ্রেণিতেই নারীরা আর্থিক এই বৈষ্যম শিকার। আর্থিক এই বৈষম্যই অনেক সময় রূপ নেয় পারিবারিক সহিংষতায়। বিশ্ব জুড়ে ৮ মার্চ পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য- ‘টেকসই আগামীর জন্য, জেন্ডার সমতাই আজ অগ্রগণ্য’।
তবে একুশ শতকের এই যুগেও সমাজের সব পর্যায়েই প্রকট ভাবে চোখে পড়ে লিঙ্গ বৈষম্য। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ওয়াসিফা তাসনিম শাম্মা যুগান্তরকে বলেন, নারীরা শিক্ষা সাহিত্যে কর্মে ক্রীড়ায় এগিয়ে গেলেও কমেনি তাদের প্রতি সহিংসতা। নারীরা আগে কেবল ঘরের মধ্যে বন্দি থাকার কারণে সহিংসতাও ঘরের মধ্যেই বন্দি ছিল।
কিন্তু আজ অপ্রতিরোধ্য গতিতে নারীরা ঘরের বাইরে বিচরণ করায় নারীর প্রতি সহিংসতা নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রচলিত পুরুষতত্ত্ব ও পুরুষতান্ত্রিকতা নারীকে ঘর বা বাইরে থামানোর জন্য শুরু করেছে নতুন ধরনের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, নানানরকম মানহানিকর ঘটনা। ডমেস্টিক ভায়োলেন্স তার আবদ্ধ গন্ডি থেকে বেরিয়ে পাবলিক প্লেস ও ওয়ার্ক প্লেস ভায়োলেন্স এ রূপ নিয়েছে।
অর্থনৈতিক বৈষ্যমের ব্যাপারে ওয়াসিফা তাসনিম শাম্মা বলেন, মেয়েরা চাকরি করলে ও বেতনের উপর থাকে না নিয়ন্ত্রণ, চাকরি থেকে বাসায় ফিরতে দেরি হলে বা কর্মযজ্ঞ কিংবা সংসারে এতটুকু আঘাত হানলে চলে নানান ধরনের অসম্মানজনক ও অপ্রীতিকর ঘটনা। এ দিকে ঘরের বাইরে অলিতে-গলিতে, পাবলিক বাসের ভিতরে বা কাজের জায়গাতেও বিভিন্নভাবে চলে নারীকে উত্যক্ত করার প্রচেষ্টা ও সহিংসতা।
এই বৈষ্যমের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এসবই ঘটেছে প্রথাগত পুরুষত্ব ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে ও নারীর এগিয়ে যাওয়াকে সহজভাবে ও বন্ধুসুলভভাবে মেনে নিতে পারেনি বলে। অন্যদিকে পুরুষের বেকার জীবন যাপন, সামাজিক মুল্যবোধের অবক্ষয়, অসামাজিক কার্যকলাপের প্রতি আসক্তি, ফেসবুক, ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতাও এর অন্যতম কারণ।
তবে এই বৈষ্যমের জন্য নারীরাও কম দায়ি নয় উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক আরও বলেন, এই বৈষ্যমের অন্যতম আরেকটি কারণ হল নারীর প্রতিবাদহীনতা। এমনকি উচ্চশিক্ষিত ও প্রগতিশীল মেয়েরাও মুখ বন্ধ করে মেনে নিচ্ছেন ঘরে বাইরে ঘটে যাওয়া নানান ধরনের শারীরিক ও মানসিক চাপ প্রয়োগের ঘটনা, মানহানিকর কার্যকলাপ। তারা হয়তো ভাবছেন – মুখ খুললে সংসারটা ভেঙে যাবে,সংসারের বাইরে কোথায় যাব, প্রেমের বিয়ে বলে সংসারের কোনো কষ্ট বাবার বাড়ির কারো সাথে শেয়ার করা যাবে না। অথবা চিন্তা করছেন সমাজ কি ভাববে, সন্তানের ভবিষ্যত কেমন হবে। অথবা পাবলিক বাসের ঘটনা তো রোজকার ব্যাপার, উচ্চবাচ্য করলে হয়তো চাকরিটাও আর করা হবে না। অনেকে আশংকায় থাকেন মানহানিকর ঘটনার প্রতিবাদ করলে হয়তো তাকে আরও উত্যক্ত করা হবে।
এসব ঘটনা থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় হিসেবে ওয়াসিফা তাসনিম বলেন, এজন্য প্রয়োজন প্রচলিত সমাজের প্রথাগত মানসিকতার পরিবর্তন এবং নারীদের নিজেদের আত্মমর্যাদা ও সম্মানকে আত্মোপলব্ধি করা। যুবসমাজ ও পুরুষের জন্য আরও কর্মসংস্থান এর সুযোগ সৃষ্টি এবং শহরে গ্রামে, ঘরে বাইরে সমাজকাঠামো ও আইনী বাহিনীর নজরদারি বৃদ্ধিও প্রয়োজন। একই সঙ্গে নারীকেও প্রতিবাদমুখী হতে হবে বলে জানান তিনি।